পদার্থবিদ্যায় নোবেল, যা কি-না এই গ্রহে সব চেয়ে গ্ল্যামারাস পুরস্কার, এ বছর তা  জাপান ও কানাডার দুই বিজ্ঞানীর। যথাক্রমে তাকাকি কাজিতা এবং আর্থার ম্যাকডোনাল্ড। যে তালিকায় নাম রয়েছে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর কিংবা মারি কুরি-র মতো বিজ্ঞানীর, মঙ্গলবার তাতে নাম জুড়ে গেল কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ডের। প্রত্যেকে পাবেন ৪,৮০,০০০ ডলার।
স্টকহলমে ভিড়ে-ঠাসা সাংবাদিক বৈঠকে নোবেল কমিটি যখন দুই বিজেতার নাম ঘোষণা করলেন, তখন অবশ্যই তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না সেখানে। খবরটা পেয়ে কানাডার কিংস্টন থেকে ম্যাকডোনাল্ড সাংবাদিকদের ফোনে  জানালেন প্রতিক্রিয়া। কেমন লাগছে? ম্যাকডোনাল্ডের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘ভয়ঙ্কর অনুভূতি, বলাই বাহুল্য।’’ আর কাজিতা? তাঁর মন্তব্য, ‘‘অবিশ্বাস্য বলা চলে।’’
কোন কৃতিত্বের জন্য এই সম্মান? এক কথায় নিউট্রিনো নামে এক কণার জাদুকরী চরিত্র অনুধাবনে, বিজ্ঞানীরাও যাদের ঠাট্টা করে বলেন ‘ভূত’! উপাধিটা অমূলক নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আলোর কণা ফোটন সংখ্যায় সব থেকে বেশি। তার পরেই নিউট্রিনো। ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে প্রতি মুহূর্তে সব জায়গায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে কোটি-কোটি অর্বুদ-নির্বুদ নিউট্রিনো, কিন্তু তাদের শনাক্ত করা প্রায় দুঃসাধ্য। নিউট্রিনো যদি তির হয়, তা হলে ও-রকম লক্ষ লক্ষ কোটি তিরের ঘায়ে প্রতিনিয়ত ঝাঁঝরা হচ্ছে আমাদের দেহ, অথচ আমরা টের পাচ্ছি না কিচ্ছুটি। তাই ভূত ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়  নিউট্রিনোকে! এ হেন ভুতুড়ে কণার চরিত্র বুঝতে সাহায্য করেছেন কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ড। শুধু যে কিছুটা চেনা গিয়েছে, তা-ই নয়, এঁদের সাফল্যের সূত্র ধরে আরও ভাল করে চেনা যেতে পারে আমাদের চারপাশের সব বস্তু থেকে শুরু করে দূরদূরান্তের গ্রহতারাদেরও।
বলা বাহুল্য, পদার্থবিদ্যায় এ বারের নোবেল পুরস্কার উৎসাহিত করবে ভারতে এক ঝাঁক কণা-পদার্থবিজ্ঞানীকে। কারণ, বহু দিন স্বপ্ন দেখার পর বিরাট আকারে নিউট্রিনো গবেষণায় নামতে চলেছেন তাঁরাও। মাদুরাইয়ের কাছে ভূপৃষ্ঠের প্রায় এক কিলোমিটার নীচে গুহা কেটে যন্ত্র বসানো হচ্ছে। ওই অতি-সংবেদী যন্ত্র শনাক্ত করবে নিউট্রিনোর স্রোত, বুঝবে তাদের চরিত্র। গবেষণায় খরচ হবে হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এই ভুতুড়ে কণাটির জীবন-কাহিনি পদার্থবিদ্যায় এক বিস্ময়-উপাখ্যান। যার শুরুটা এক সমস্যাকে ঘিরে। কিছুতেই শক্তির হিসেব মিলছিল না বিশেষ এক ধরনের তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়ায়। ডিসেম্বর ১৯৩০। প্রায় গোঁজামিল ধরনের এক উপায় বাতলে সেই হিসেব মিলিয়ে দিলেন অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানী হোলফগাং পউলি। বললেন, শক্তির গরমিল কাটে, যদি এক নতুন জাতের কণার অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়। কাজটি অভিনব, কবুল করলেন পউলি নিজেই। বললেন, ‘‘ভয়ঙ্কর এক কাণ্ড ঘটিয়েছি। অনুমান করেছি এমন এক কণার, যাকে ধরা তো দূর, চিনেই ওঠা যায় না।’’ মন্দ বলেননি পউলি। সেই অনুমানের পর সিকি শতাব্দী লেগে যায় পউলি-কল্পিত সেই ভুতুড়ে কণা শনাক্ত করতে। ১৯৫৬ সালের জুন মাসে দুই মার্কিন বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক রেনস এবং ক্লাইড কাওয়ান বহু কষ্টে হাতেনাতে প্রমাণ পেলেন নিউট্রিনোর অস্তিত্বের। পেয়েই টেলিগ্রাম করলেন পউলিকে। কাল্পনিক নয়, ভুতুড়ে কণা সত্যিই আছে!
কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ড নিউট্রিনোর যে রহস্যের সমাধান করেছেন, তার শুরু ১৯৬০-এর দশকে। আর পাঁচটা নক্ষত্রের মতো সূর্যও এক অগ্নিকুণ্ড। কিন্তু আগুনের উৎসটি কী? আসলে নক্ষত্র মানে আগুনের কড়াই, যেখানে হাইড্রোজেন বনে যাচ্ছে হিলিয়াম। এই প্রক্রিয়াটির অন্যতম উৎপাদন হল নিউট্রিনো। সূর্যের তাপ আর আলোই পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখে প্রাণ। সুতরাং এই গ্রহে প্রাণের টিকে থাকার মূলেও রয়েছে নিউট্রিনোর অবদান। সূর্যের গহ্বরে নিয়ত জন্মাচ্ছে অগুণতি নিউট্রিনো। অথচ, পৃথিবীর বুকে যন্ত্র নিয়ে বসে আছেন যে সব গবেষক, তাঁরা দেখছেন সূর্যে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর দিকে রওনা দিচ্ছে যত নিউট্রিনো, এসে পৌঁছচ্ছে মাত্র তার তিন ভাগের এক ভাগ। দুই-তৃতীয়াংশই গায়েব!
ভুতুড়েগুলো যাচ্ছে কোথায়?
এই রহস্যের সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অনেক বিজ্ঞানী। সফল হন কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ড। কাজিতা গবেষণা করেছিলেন টোকিয়োর আড়াইশো কিলোমিটার দূরে সুপার-কামিয়োকাণ্ডে গবেষণাগারে, পরিত্যক্ত এক দস্তার খনিতে। আর ম্যাকডোনাল্ডের গবেষণাগার ছিল অন্টারিয়োর কাছে সাডবারি নিউট্রিনো অবজারভেটরি। যা আসলে নিকেলের খনি। ভূগর্ভে এক কিলোমিটার গভীরে খনিতে বসে ওঁরা শনাক্ত করছিলেন সূর্য কিংবা ব্রহ্মাণ্ডের অন্যান্য উৎস থেকে পৃথিবীতে ধেয়ে আসা নিউট্রিনোদের। ওঁরাই ফাঁস করেন নিউট্রিনোদের গায়েব হয়ে যাওয়ার ভুতুড়ে স্বভাবের কারণ। কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ড বুঝতে পারেন নিউট্রিনো শুধু ভূতই নয়, জাদুকরও বটে। নিউট্রিনো তিন জাতের। টাউ নিউট্রিনো, ইলেকট্রন নিউট্রিনো এবং মিউওন নিউট্রিনো। প্রায় আলোর বেগে আসতে আসতে নিউট্রিনোগুলি সব সময় ভেক বদল করে। এক জাত বদলে যায় অন্য জাতে। সূর্যে জন্মাচ্ছে ইলেকট্রন নিউট্রিনো। কিন্তু তার সবটা পৃথিবীতে এসে পৌঁছচ্ছে না ওই চেহারায়। কোনওটা বনে যাচ্ছে টাউ নিউট্রিনো, কোনওটা মিউওন নিউট্রিনো। সুতরাং সূর্য-থেকে-আসা নিউট্রিনো খুঁজলে দুই-তৃতীয়াংশ তো হারিয়ে যাবেই। ব্যস! সমস্যা খতম!
নাহ্। বিজ্ঞানে বুঝি নটে গাছটি অত সহজে মুড়োয় না। এক নিউট্রিনো-রহস্যের সমাধান উপহার দিল আর এক ধাঁধা। বিজ্ঞানের নিয়ম বলছে, নিউট্রিনো যাত্রাপথে ভেক বদল করতে পারে যদি তার ভর থাকে। অথচ কণা-পদার্থবিদ্যার সব চেয়ে সফল তত্ত্ব ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ কিন্তু বলে আসছিল নিউট্রিনোর ভর নেই। এরা আলোর কণা ফোটনের মতোই ভরহীন। কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ডের পরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে, সামান্য হলেও ভর আছে নিউট্রিনোর। তার মানে খুঁত আছে ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’-এ! তার সংশোধন দরকার। খুঁত কিংবা ফাঁকফোকর বিজ্ঞানীদের কাছে বড় লোভনীয়। নিউট্রিনো যে খুঁত ধরেছে ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’-এর, তাতে মহা খুশি গবেষকেরা। এ বার তাঁরা উঠেপড়ে লেগেছেন সেই সংশোধনের কাজে।
বিজ্ঞানীদের সামনে এখন অনেক প্রশ্নের ভিড়। নিউট্রিনো ভর পায় কোথা থেকে? তার ভর এত কম কেন? তিন জাতের বাইরে আর কোনও জাতের নিউট্রিনো আছে কী? নিউট্রিনোর কেন এই ভুতুড়ে স্বভাব? কেন তারা মেশে না অন্যদের সঙ্গে?
এর এক একটির সদুত্তরে নিশ্চয়ই লেখা আছে ভবিষ্যতের নোবেল বিজেতাদের নাম!