গ্রাহকেরা খুশি। ক্ষুব্ধ টেলি পরিষেবা সংস্থাগুলি। এতটাই যে, প্রয়োজনে টেলিকম নিয়ন্ত্রক ট্রাইয়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না তারা।
বেশ কিছু দিন ধরেই সারা দেশে শোরগোল ফেলেছে মোবাইলে কথা বলতে বলতে মাঝপথে ফোন কেটে যাওয়ার (কল ড্রপ) সমস্যা। অবশেষে তা মেটাতে টেলি পরিষেবা সংস্থাগুলিকে গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিল ট্রাই। জানাল, প্রতি কল ড্রপের জন্য এক টাকা করে (দিনে ৩ বার পর্যন্ত) ক্ষতিপূণ গুনতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে। তা কার্যকর হবে জানুয়ারি থেকেই।
এই ঘোষণা স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা স্বস্তি জুগিয়েছে গ্রাহকদের। কিন্তু তেমনই তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধেছে টেলিকম শিল্পমহলের মধ্যে। তাঁদের অভিযোগ, ওই সমস্যার দায় অযথা চাপানো হচ্ছে সংস্থাগুলির উপর। শাস্তি দেওয়া হচ্ছে অন্যায় ভাবে। এবং এ ভাবে ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে আখেরে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে টেলিকম শিল্পকেই। কারণ, শুধু এই সিদ্ধান্তের জেরেই দিনে অন্তত ১৫০ কোটি টাকার বাড়তি বোঝা সংস্থাগুলির উপর চাপবে বলে তাঁদের আশঙ্কা। আর সেই কারণেই টেলিকম ট্রাইব্যুনাল টিডিস্যাটে মামলা করার পথও খোলা রাখছে শিল্পমহল।
দেশজুড়ে কল ড্রপের ভোগান্তি থেকে সাধারণ গ্রাহক তো ছাড়, রেহাই পাননি মন্ত্রী, আমলা এমনকী টেলিকম শিল্পের প্রতিনিধিরাও। বিষয়টি নিয়ে চাপান-উতোরের মধ্যেই এ প্রসঙ্গে সব পক্ষের মতামত চেয়েছিল ট্রাই। তারপরই এই সিদ্ধান্ত।
বৃহস্পতিবারই ক্ষতিপূরণ বসানোর ইঙ্গিত মিলেছিল। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার আইন সংশোধন করে ট্রাই জানিয়েছে, প্রতিটি কল ড্রপের জন্য এক টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে দিনে তিন বারের বেশি (দিনে তিন টাকা) কোনও গ্রাহক তা পাবেন না। যিনি ফোন করছেন, তাঁর টেলি পরিষেবা সংস্থার নেটওয়ার্ক খারাপ হওয়ার কারণে কল কাটলে, তবেই ক্ষতিপূরণ মিলবে। যিনি ফোন ধরেছেন, তাঁর নেটওয়ার্ক খারাপ থাকলে নয়।
রাত ১২টা থেকে পরদিন রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত এক দিন হিসেবে ধরা হবে। কল ড্রপ হওয়ার চার ঘণ্টার মধ্যে গ্রাহককে এসএমএস বা ইউএসএসডি-র মাধ্যমে জানাতে হবে যে, তাঁর অ্যাকাউন্টে কত টাকা পাঠানো হয়েছে। পোস্ট-পেড গ্রাহকদের তা জানাতে হবে পরের বিলে।
ট্রাই মনে করছে, এর ফলে গ্রাহকদের ক্ষতি যেমন কিছুটা পোষানো যাবে, তেমনই জরিমানার গুঁতোয় উন্নত হবে পরিষেবার মানও। কতক্ষণ পর্যন্ত ফোন করার পরে মাঝপথে তা কেটে গেলে সেটিকে কল ড্রপ হিসেবে ধরা হবে, তা নিয়ে নানা জল্পনা রয়েছে বিভিন্ন মহলে। কিন্তু তা উড়িয়ে ট্রাই-এর সচিব সুধীর গুপ্ত এ দিন জানান, এমন কোনও মাপকাঠি বেঁধে দেওয়া হয়নি।
ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্তে স্বস্তি পাওয়া গ্রাহকদের আশা, এ বার ওই ক্ষতি এড়াতে উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণে আগ্রহী হবে টেলি সংস্থাগুলি। ট্রাইয়ের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে টেলিকম মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদও বলেন, ‘‘মাসুলের ক্ষেত্রে ট্রাই-ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। টেলিকম সংস্থা ও সরকার— উভয়েই তা মানতে বাধ্য। আশা করি, এই নির্দেশ গ্রাহকদের উদ্বেগ কমাবে।’’
তবে টেলি পরিষেবা শিল্পের দুই সংগঠন সিওএআই এবং এইউএসপিআই-এর পাল্টা দাবি, শাস্তি দিয়ে পরিষেবার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের যুক্তি, একাধিক কারণে কল ড্রপ হচ্ছে। যার বেশিরভাগেরই দায় টেলিকম শিল্পের নয়। যেমন, সিওএআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল রাজন এস ম্যাথুজ এবং এইউএসপিআই-এর সেক্রেটারি জেনারেল অশোক সুদের দাবি, টেলিকম শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়নে আগ্রহী। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও স্থানীয় পুরসভার হস্তক্ষেপেই টাওয়ার বসানো যাচ্ছে না। দিল্লিতে তিনশোরও বেশি টাওয়ার বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। ‘স্কাইলাইন’ ঢেকে যাওয়ার যুক্তিতে টাওয়ার বসাতে দেওয়া হচ্ছে না মধ্য দিল্লির ‘ভিআইপি’ এলাকায়। অন্যত্রও নতুন টাওয়ার বসানোর ছাড়পত্র দিতে অনেক সময় নেয় স্থানীয় প্রশাসন। তাই যথেষ্ট টাওয়ার না-থাকার পিছনে যেখানে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দায়ী, সেখানে ক্ষতিপূরণ বসানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
একই সঙ্গে টেলি পরিষেবা সংস্থাগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, ইতিমধ্যেই মাসুল হার প্রতি মিনিটের বদলে সেকেন্ডে নির্ধারণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ফলে ফোন কেটে গেলেও যতটুকু কথা বলছেন, তারই মাসুল দিতে হচ্ছে তাঁদের।
সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের অভিযোগ, তারা পরিকাঠামোয় যথেষ্ট পরিমাণে লগ্নি করেনি বলেই আজ এই সমস্যা। কিন্তু তা মানতে নারাজ ম্যাথুজের দাবি, গত দু’তিনটি ত্রৈমাসিকে টেলিকম শিল্পেই সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি এসেছে। তা ছাড়া, পরিষেবার মান খারাপ করে প্রতিযোগিতার বাজারে গ্রাহক হারাতে চায় না কেউই।
ম্যাথুজের অভিযোগ, দেশে ১০০ কোটি গ্রাহকের অর্ধেককেও যদি ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তা হলে তার দৈনিক অঙ্ক দাঁড়াবে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এই বিপুল বোঝার জন্যই বরং নতুন লগ্নি করতে সমস্যায় পড়বে টেলিকম শিল্প। সুদেরও দাবি, গ্রাহক-পিছু আয়ের বড় অংশই তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে চলে গেলে, সমস্যা বাড়বে টেলিকম শিল্পের। তাঁদের প্রশ্ন, ট্রাইয়ের নিয়মে ২% কল ড্রপ বৈধ। নতুন নির্দেশে গুণগত মানের মাপকাঠি ভাঙার জরিমানা বাড়িয়েছে ট্রাই। তা হলে এই সবের উপর ফের গ্রাহককে দিতে আলাদা ভাবে ক্ষতিপূরণ চাপানোর যৌক্তিকতা কী?
টেলিকম শিল্পের দাবি, সম্প্রতি ভোডাফোন, এয়ারটেলের পুরনো স্পেকট্রাম ফিরিয়ে নতুন করে নিলাম হয়েছে। ফলে সেগুলির কম্পাঙ্ক বদলেছে। সেই সঙ্গে এসেছে থ্রিজি ও ফোরজি প্রযুক্তি। পরিকাঠামোর অভাবের পাশাপাশি প্রযুক্তির এই বদলও কল ড্রপের সমস্যার কারণ।
ম্যাথুজ জানান, নিজেদের মধ্যে আলোচনার পরে উদ্বেগের বিষয়গুলি নিয়ে আগামী সপ্তাহে ট্রাইয়ের দ্বারস্থ হবেন তাঁরা। সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেলে, টিডিস্যাটে মামলার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি তিনি। আগামী সপ্তাহে বিষয়টি পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ করার কথা জানিয়েছেন সুদও।
No comments:
Post a Comment