প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার হারানো ইতিহাসের খোঁজ মিলল গ্রিসের মাটিতে।
গ্রিসের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের প্রাচীন শহর পাইলোয় প্রত্নতত্ত্ববিদ দম্পতি জ্যাক এল ডেভিস এবং শ্যারন আর স্টকারের নেতৃত্বে খননকার্য চালাচ্ছিল একটি দল। গত ২৫ বছর ধরে পাইলোতেই কাজ করছেন তাঁরা। প্রাচীন যুগের বাসিন্দাদের বাড়িঘর খুঁজে বের করে তাঁদের নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। ১৮ মে সেখানে একটি সমাধির খোঁজ পান দম্পতি। তবে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। ভেবেছিলেন কোনও পুরনো বাড়ি। বিশেষত্বও তো কিছুই ছিল না।
তবে দিন কয়েকেই ভুল ভাঙল তাঁদের। ৫ ফুট গভীর, ৪ ফুট চওড়া এবং লম্বায় প্রায় ৮ ফুট সমাধিটিতে নেমে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগাড়। সমাহিত ব্যক্তির যে টুকু দেহাবশেষ তখনও অবশিষ্ট ছিল, তা বিশ্লেষণ করা হয়। জানা যায় মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। কফিনের বঁা দিকে রাখা ছিল ব্রোঞ্জের একটি বিশাল তলোয়ার, হাতল হাতির দাঁত দিয়ে বাঁধানো। ছিল সোনা দিয়ে কাজ করা একটি ছোরাও। ডান দিকে চোখে পড়ে গোটা পঞ্চাশেক সিলমোহর, চারটি সোনার আংটি। তার কারুকার্যে মিনো সভ্যতা (২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্রিট দ্বীপে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা)-র ছাপ স্পষ্ট। সমাধিতে সোনা, রুপো এবং ব্রোঞ্জের পেয়ালা ছিল বেশ কয়েকটি। সমাহিত ব্যক্তির পায়ের কাছে ছিল হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি করা একটি স্মারক। তাতে খোদাই করা ছিল ‘গ্রিফিন’ নামের এক পৌরাণিক প্রাণীর অবয়ব। ডঃ ডেভিস এবং ডঃ স্টকার তাই ওই সমাধির নাম দিয়েছেন ‘গ্রিফিন যোদ্ধার সমাধি’।
ওই ব্যক্তি যে তৎকালীন সমাজে এক জন গণ্যমান্য যোদ্ধা ছিলেন, সে প্রমাণ প্রত্নতত্ত্ববিদেরা পেয়েছেন। প্রাচীন কালের ওই যোদ্ধা যে সাজতে-গুজতেও পছন্দ করতেন, সমাধি ঘেঁটে সেই প্রমাণও মিলেছে। অস্ত্র ছাড়াও হাতির দাঁতের হাতল-সহ একটি ব্রোঞ্জের আয়না এবং হাতির দাঁতের গোটা ছয়েক চিরুনিও মিলেছে সেখান থেকে। ওই প্রত্নতত্ত্ববিদ দম্পতির কথায়, ‘‘গত ৬৫ বছরে এমন সম্পদশালী সমাধি আর একটিও আবিষ্কার হয়নি। আশ্চর্যের বিষয়, এই সমাধির অস্তিত্বের কথাও কেউ জানত না। তাই তিন শতকেরও বেশি অক্ষত রয়েছে প্রতিটি জিনিস। আমরাই প্রথম সেখানে পৌঁছেছি ভেবেই অদ্ভূত লাগছে।’’ আরও অদ্ভুত হল ওই ব্যক্তিকে সমাহিত করার সময়। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সমাধিটি তৈরি হয়। এর কয়েক বছর পরেই ওই সমাধিটির কাছাকাছি এলাকায় তৈরি হয় নেস্টরের প্রাসাদ। যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি সাম্রাজ্য। ১১৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার পতন হয়। ঠিক এই রকম সময়েই পতন হয়েছিল হোমারের ট্রয়-এরও।
এখানেই ধন্দে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। ‘গ্রিফিন যোদ্ধার’ সমাধিতে যে সব জিনিস পাওয়া গিয়েছে, সেগুলিতে মিনো সভ্যতার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু যে জায়গা থেকে সমাধিটি উদ্ধার হয়েছে সেখানে গড়ে উঠেছিল মাইসিন সভ্যতা। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মিনো এবং মাইসিনরা একাধিক বার যুদ্ধে জড়িয়েছে। ফলে ‘গ্রিফিন যোদ্ধা’র সমাধি থেকে পাওয়া সম্পদগুলি তাঁর নিজের এলাকার নাকি লুঠতরাজ করে পাওয়া— সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এমনকী যে ধরনের জিনিসগুলি তাঁর সমাধিতে দেওয়া হয়েছে, তার কোনও অন্তর্নিহিত অর্থ থাকতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। দুই সভ্যতার বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর এই সমাধিতেই লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
No comments:
Post a Comment