গরম ওভেন! রাজকোটের খান্ডেহরি ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে নাকি তেমনই মনে হচ্ছিল ফাফ দু’প্লেসির। ব্যাট করে উঠে পড়ন্ত বিকেলে টিভি ইন্টারভিউয়ে তো এ কথাই বললেন তিনি।
কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত নামল, তখন জায়গাটাকে অন্যরকম লাগছিল।
লোয়ার ম্যানহাটন!
২০০১ পর্যন্ত যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল টুইন টাওয়ার। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। টিম ইন্ডিয়ার পরপর দুটো টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় দলটাকে সেই টুইন টাওয়ার ধ্বংসোত্তর নিউ ইয়র্কের মতোই দেখাচ্ছিল যেন। বিধ্বস্ত, অপদস্থ।
রবিবার দুপুর-বিকেলে রাজকোটের অদূরে খান্ডেহরি ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে তখন সত্যিই মনে হচ্ছিল আগুনের উপর বসানো কোনও ওভেন বা প্রেসার কুকার। ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা। ৩২ শতাংশ আর্দ্রতা। হাওয়া বলতে কিছুই নেই। এই অসহ্য গরমে হাঁসফাঁস ক্রিকেটপ্রেমীদের তখন একটাই কামনা, সূর্য ডুবলে আরাম। সঙ্গে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের জাদু। দুইয়ে মিলে ‘আচ্ছে দিন’-এর আশা তখন প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যের মানুষগুলোর মনে।
কিন্তু তা আর হল কোথায়? ভারতের ওয়ান ডে ও টেস্ট ক্যাপ্টেনের আশি রানের যুগলবন্দি গ্যালারির হাজার পঁচিশের মনে যে আশার ইমারত তৈরি করেছিল, তাঁদের জুটি ভেঙে যেতেই তা যেন জঙ্গি বিমান হানায় টুইন টাওয়ারের মতো ভেঙে পড়ল।
প্রথম টাওয়ারটা— ক্যাপ্টেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। হানাদার মর্নি মর্কেল ও ডেইল স্টেইন। অফ স্টাম্পের বাইরে ফেলা মর্কেলের শর্ট বল থার্ড ম্যানে স্টেইনের হাতে পৌঁছে দিলেন অধিনায়ক। পরেরটা বিরাট কোহলি। এ বারও মর্কেলের হানা। সঙ্গী বদলে ডেভিড মিলার। এ বারের শর্ট বলটা লেগ স্টাম্পে। সেঞ্চুরি থেকে ২৩ রান দূরে থাকা বিরাটের ব্যাট থেকে তা সোজা ডিপ মিড উইকেটে মিলারের হাতে। অজিঙ্ক রাহানের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে কোহলি যখন প্যাভিলিয়নের পথে, তখন ভারতের সামনে ২৮ বলে ৫৫ তোলার চ্যালেঞ্জ। আইসিইউ থেকে বের করে আনা ফর্ম সঙ্গে নিয়ে নেমেছিলেন সুরেশ রায়না। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে গিয়ে নিজের ফর্মকে সেই আইসিইউ-তেই রেখে দিলেন। রক্তের স্বাদ পেয়ে যাওয়া মর্কেলের ধারালো দাঁত নখ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না রাহানেও। অনায়াসে বড় শট খেলবেন, উইকেটের সে অবস্থাও তো নেই। পঞ্চাশ ওভারের রগড়ানিতেই উইকেটের গতি জং ধরা গাড়ির ইঞ্জিনের মতো হয়ে পড়ল। অক্ষর পটেল-হরভজন সিংহরা আর কী করবেন? তখন তো ম্যাচ ভারতের হাতের বাইরে। শেষ পর্যন্ত যা ১৮ রানে জিতে নিল দক্ষিণ আফ্রিকা। গরমে গরমে সিরিজটা ২-১ করে নিল তারা। বৃহস্পতিবার চেন্নাইয়ে কেল্লাফতে হলেই সিরিজও তাদের পকেটে।
রবিবার রাজকোটের মাঠে ও মাঠের বাইরে দুই আলাদা যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। কিন্তু হেরে গেলেন দুই নায়কই। এক দিকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। অন্য দিকে হার্দিক পটেল। ‘নিশ্ছিদ্র’ নিরাপত্তার দাবি থাকা সত্ত্বেও দুপুরে বিক্ষোভ দেখাতে স্টেডিয়ামের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ঢুকে পড়া হার্দিকের গ্রেফতার সকাল থেকে তৈরি হওয়া অশান্ত আবহাওয়াকে কিছুটা শান্ত করলেও রাতে এই হার নবরাত্রির আনন্দে ভরা পরিবেশকে যেন কেমন ঝিমিয়ে দিল। সেই ঝিমুনি ধূর করে শহরের মানুষকে নবরাত্রির মোডে ফেরাতেই বোধহয় হারের পরও আতসবাজির ধামাকা।
সকালে শহর থেকে জামনগর হাইওয়ে হয়ে স্টেডিয়ামে আসার পথে যেমন দু’ধারের ছবিটা দেখে একটা শব্দই মনের মধ্যে ঝলসে উঠছিল— যুদ্ধ। মাঠের মধ্যে বাইশ গজের লড়াইয়ে কিন্তু সেই রণং দেহি ভাবটা উধাও হয়ে গেল।
হার্দিক পটেল দুপুরে ম্যাচ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই জামনগর থানার এসপি প্রদীপ সেজুল গ্রেফতার করে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছেন শুনে স্টেডিয়ামে কর্তব্যরত পুলিশ কর্তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও মাঠের মধ্যে তখন দমবন্ধ অবস্থা ভারতীয় বোলারদের। প্রোটিয়াদের ব্যাটিং যে তখন তাঁদের শিবিরে তিনশোর আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এবি ডেভিলিয়ার্সের দলে এত দিন যাঁরা রানে ছিলেন না, পাটা, হাইওয়েসম উইকেট পেয়ে তাঁরাও মনের সুখে রান করে যাচ্ছিলেন। কুইন্টন ডি’ কক এ বছর প্রথম ওয়ান ডে সেঞ্চুরি পেলেন। জুলাইয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপরাজিত ৬৩-র পর কানপুর, ইনদওরে রানে ফেরা দু’প্লেসি এ দিনও ৬০। ডেভিড মিলার শুধু পারলেন না। হাসিম আমলার জায়গায় ওপেন করতে এসেও না। দু’প্লেসি ও ডি ’ককের ১১৮-র পার্টনারশিপের পর যখন পাঁচ রানের মধ্যে তিনটে উইকেট ফেলে দিলেন শিখর ধবন (তাঁর থ্রোয়ে রান আউট), মোহিত শর্মা ও অক্ষর পটেল (যথাক্রমে ডিকক, দু’প্লেসি ও ডে’ভিলিয়ার্স), তখন থেকেই আতঙ্ক উধাও। এই উইকেটে বিপক্ষকে ২৭০-এ বেঁধে রাখাটা কৃতিত্বেরই বলতে হবে। কিন্তু সেই কৃতিত্বের দাম দিতে পারলেন না ব্যাটসম্যানরা। রোহিতের ৬৫ শুরুটা ভাল করলেও ভারতের লড়াই এত বেশি ধোনি-কোহলির টুইন টাওয়ারকেন্দ্রিক হয়ে উঠল যে তাঁদের ব্যর্থতাই দলের হারের সূচনা করে দিল।
সিএসকে-র নির্বাসনে রবিবার বোর্ড সিলমোহর লাগিয়ে দিল, সেই দুঃখ ভোলানোর জন্য কি এ বার দল নিয়ে ঝাঁপাবেন চেন্নাইয়ের প্রিয় ‘হুইসল পোড়ু’? নাকি এ বার চেন্নাইও তাঁকে ফিরিয়ে দেবে? উত্তর জানতে লাগবে আরও ক’টা দিন। বৃহস্পতিবার।
No comments:
Post a Comment