ওয়াংখেড়ে রাতের সঙ্গে তো কিছুতেই মেলানো গেল না!
দোসরা এপ্রিলের মোহিনী রাত ভারতবাসীর পক্ষে ভোলা যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনই অসম্ভব ওই বিখ্যাত মুহূর্তের স্মৃতির ভল্ট থেকে হারিয়ে যাওয়া। নুয়ান কুলশেখরাকে বিশাল ছয়টা মেরে যে ভাবে সে দিন থেমে গিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বজয় উত্তর ওই শীতল ঔদ্ধত্যই দাঁড়িয়েছিল তার প্রতীক, ব্র্যান্ড এমএসডি। দোসরা এপ্রিলের আগে-পরে দেশকে বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন ধোনি। কিন্তু কখনও কখনও আবেগকে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ম্যাচ জিততে দেননি। চূড়ান্ত সাফল্যের মুহূর্তে প্রকাশ্য উৎসবে কার্পণ্যই ছিল তাঁর কিংবদন্তির অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ।
সেই মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আজ বিপক্ষের নিম্নবিত্ত ব্যাটসম্যানকে আউট করে শিশুর উল্লাসে লাফাচ্ছেন! স্লিপ ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ জমা পড়লে আনন্দে ফিস্ট পাম্প করছেন! সিরিজ জিতে নয়, সিরিজ ১-১ করার স্মারক হিসেবে স্টাম্প তুলে হাঁটছেন ড্রেসিংরুমের দিকে! জড়িয়ে ধরছেন সুরেশ রায়নাকে, উত্তেজনার আগুনে ধকধক করছে চোখমুখ।
চার বছর অনেকটা সময়। অনেক কিছু তাতে পাল্টে যায়। এবং কোনও এক মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও পাল্টে যান!
বুধবার রাতের পর ভারতীয় ক্রিকেট সার্কিটে নিঃসন্দেহে একটা বিষয় নিরন্তর চর্চিত হবে। যে, ১৪ অক্টোবরের ইনদওর এমএস ধোনির ক্রিকেটজীবনের অন্যতম সেরা জয়ের সাক্ষী থেকে গেল কি না। পুঁচকে শহরটা তো অংশীদার হয়ে থাকল এমন একটা দিনের, যা দেখল দীর্ঘ খরার শুকনো মাটিতে রানের রিমঝিম বৃষ্টি। সি কে নাইডু-মুস্তাক আলির শহর দেখল একদা প্রবাদপ্রতিম, ক্রমশ ফ্যাকাশে দেখানো সোনার কপালে আবার রোদের ঝিকমিক। দেখল সমালোচকদের কঠিন আস্কিং রেটের ধুলোয় লুটনো।
যে দিনটা ধোনি শুরু করেছিলেন শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে রেখে নয়। তাদের পাশাপাশি আরও তিন ‘শত্রু’র উপস্থিতি জেনে। এক নম্বর, নিজস্ব ব্যাটিং ফর্ম। সাম্প্রতিক সময়ে যে ব্যাট থেকে রান বাবরের আমলের স্বর্ণমুদ্রার মতোই দুষ্প্রাপ্য দেখাচ্ছিল! দু’নম্বর, অধিনায়কত্ব। সেই বিখ্যাত কপাল কাজ করছিল না বহু দিন। আর তিন, হারের অন্ধগলিতে আটক একটা টিম। যাদের দেশের মাটিতে পরের পর যুদ্ধে নামতে দেখেও ক্রমাগত মনে হচ্ছিল, ম্যাচগুলো নির্ঘাৎ ডারবান বা জো’বার্গে হচ্ছে।
গোটা দিনে ঘণ্টা আটেকের সময়ে যে তিন শত্রুকে এমএস ধোনি খেললেন এবং পত্রপাঠ হোলকারের বাইরে ফেলে দিলেন!
রাহুল দ্রাবিড়ের নামাঙ্কিত ড্রেসিংরুম থেকে যখন বেরোচ্ছেন সাত নম্বর জার্সি, ভারতীয় ইনিংস কুড়ি ওভারেও পড়েনি। শেষ কবে তিরিশ ওভারের বেশি ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন ভারত অধিনায়ক, খুঁজতে গেলে বোধহয় সারা রাত লেগে যাবে। শিখর ধবন, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা ফিরে গিয়েছেন। ব্যাটিং ধ্বংসস্তূপের মাঝে অজিঙ্ক রাহানের ব্যাট থেকে খান পঞ্চাশেক রানের বেশি নির্ভরতা আসেনি। সুরেশ রায়নাকে মিনিটপাঁচেকের বেশি পাননি। টিমের ইনিংস পঁচিশ ওভারে পা দেওয়ার আগে সঙ্গী হিসেবে এসেছেন একের পর এক টেলএন্ডার। অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের মেঘ জমিয়ে। সিরিজ-বিসর্জনের আগাম ইঙ্গিত দিয়ে।
যে প্রেক্ষিতে ১০২ স্ট্রাইকরেট রেখে ৮৬ বলে ধোনির অপরাজিত ৯২-কে মোটেও সেঞ্চুরির চেয়ে আট রান কম দেখাবে না। বরং তাঁর এক-একটা রানকে মনে হয়েছে দশ রানের সমান! লিওনেল মেসি যেমন বয়সের সঙ্গে নিজেকে আপফ্রন্ট থেকে মাঝমাঠে নামিয়ে এনেছেন জেনে যে তাঁর ম্যাচের দখল নিতে আগের চেয়ে সময় লাগে, ধোনিও যেন তাই। জানেন, আগের মতো খুনখারাপি এখন আর ইচ্ছেমতো আসবে না। এখন আগে ভিত তৈরি করতে হবে, তার পর বিস্ফোরণ। বোঝেন, ইন্সট্যান্ট কফির মতো ইন্সট্যান্ট বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারি আসার দিন শেষ। সিঙ্গলসে আগে সেট হতে হবে। তার পর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। এ দিন যেমন বাকিদের ছেড়ে টার্গেট করলেন জেপি দুমিনিকে। মর্কেল-তাহিরদের সিঙ্গলস নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আচমকা দুমিনির এক ওভার থেকে সতেরো। কারণ সহজবোধ্য। এবি ডে’ভিলিয়ার্সের টিমে দু’টো নড়বড়ে জায়গা। ব্যাটিং লাইন আপে ডেভিড মিলার। বোলিংয়ে ফিফথ বোলার। মানে, দুমিনি। ধোনি প্রবল চাপে পড়েও যে দুর্বলতার ফাঁক দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা বোলিংকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে গেলেন। গোটা ইনিংসে ধোনিসুলভ ঔদ্ধত্যের উদাহরণ মোটে একটা। শেষ ওভারে যখন কাগিসো রাবাদাকে সপাটে ছয় মারার পর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে, এক বারও পিছনে না ফিরে ধোনি সোজা ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন। বাউন্ডারি লাইনের ধারে একটা বিলবোর্ড দেখা গেল, তাঁর আসুরিক শটে ভেঙেচুরে পড়ে আছে।
নীরব, অথচ সরব বিবৃতি।
অধিনায়ক হিসেবে প্রাপ্তির খাতায়ও অপূর্ণতা শব্দটা থাকল কোথায়? দু’টো ফাটকা এ দিন খেলেছেন ধোনি। ফাটকা ১— অভিজ্ঞ অমিত মিশ্রকে বসিয়ে অক্ষর পটেলকে খেলানো। ফল— তরুণ বাঁ হাতি স্পিনারের সেরা ওয়ান ডে বোলিং। হাসিম আমলাকে পর্যন্ত নাকানিচোবানি খাইয়ে দেওয়া। ফাটকা ২— ভুবনেশ্বরকে ছয় মারার পরের ওভারে এবির সামনে সমধর্মী পেসার মোহিত শর্মাকে নিয়ে আসা। ফল— প্রথম বলেই এবির উইকেট।
ধোনি ধমাকা আর বোলারদের ব্যাঘ্রগর্জন, দুইয়ে মিলে টিম ইন্ডিয়ার গুমোট আবহাওয়া উধাও। শর্ট বলের গোলকধাঁধায় রায়নার ঘুরপাক খাওয়া, ধর্মশালায় রোহিত শর্মার পর এ দিন রাহানের সঙ্গেও রান নেওয়ার সময় বিরাটের ভুল বোঝাবুঝি এবং ক্রোধ প্রদর্শন, ব্যাটিং কম্বিনেশন এখনও থিতু না হওয়া, তুখোড় আফ্রিকান গেমপ্ল্যানের সামনে কারও কারও আত্মসমর্পণ— এ সব প্রশ্নও আপাতত ভুলে থাকা।
প্রশ্ন নয়, আজ প্রত্যাবর্তনের দিন। ড্রেসিংরুমের বারান্দায় রবি শাস্ত্রীর সদর্প স্টান্স নেওয়ার দিন। আনন্দের হাই-ফাইভের দিন। আতসবাজির ইনদওরে অকাল দীপাবলি উদযাপনের দিন। সর্বোপরি, পুনর্জন্মের দিন।
সরকারি বার্থ সার্টিফিকেটে জন্ম তারিখ ৭ জুলাই থাকতে পারে। তবে বুধবারের পর ১৪ অক্টোবর দিনটাতেও যদি ধোনির জন্মদিনের উৎসব পালন হয়, আপত্তি কীসের।
জীবন না হোক, আজ তো তাঁর ক্রিকেটজীবনের নতুন জন্মদিন!
No comments:
Post a Comment