জামার বুকে আটকানো ব্যাজে নেতাজির ছবি ঝুলছে। কিন্তু খোদ নেতাজিই যেন হাতছাড়া হয়ে গিয়েছেন!
সংসদে ফরওয়ার্ড ব্লকের উপস্থিতি মুছে গিয়েছে। কোনও সাংসদ নেই বলে দিল্লিতে কোনও বাংলো মেলেনি। ফলে বহু দিনের পুরনো দফতর থেকে ভিটেছাড়া হতে হয়েছে। বিধায়ক ও কোচবিহারের জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তাতেও এমন ‘গেল, গেল’ রব ওঠেনি! কিন্তু এ বার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠিত দল থেকে নেতাজিকেই ছিনিয়ে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরেন্দ্র মোদী!
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আগেই নেতাজি সংক্রান্ত গোপন ফাইল প্রকাশ করে দিয়েছেন। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে চলেছেন মোদী। নেতাজির পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁর সরকার আগামী ২৩ জানুয়ারি থেকে নেতাজি সংক্রান্ত গোপন ফাইল প্রকাশ করা শুরু করবে। ফরওয়ার্ড ব্লক বলে যে একটা দল আছে, তারা যে এত দিন এই সব দাবিতেই আন্দোলন করে এসেছে —সবাই যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছে!
এমন সঙ্কটে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে নাগরিক সম্মেলন ডেকে মাঠে নেমেছেন ফ ব নেতারা। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি! পশ্চিমবঙ্গ সরকার নেতাজি সংক্রান্ত ফাইল প্রকাশের পরেই এই নাগরিক সম্মেলনের ডাক দিয়ে ফ ব-র পরিকল্পনা ছিল, ফাইল প্রকাশ করার দাবি তোলা হবে। কিন্তু এর মধ্যেই মোদী নেতাজির পরিবারের সঙ্গে বাড়িতে কথা সেরে টুইট করে ফাইল প্রকাশের ঘোষণা করে দিয়েছেন! ফ ব-র সম্মেলনে এসে অন্য বাম দলের নেতারা তাই কানে কানে জানতে চেয়েছেন, মোদী তো ঘোষণা করেই দিলেন! আপনারা এ বার কী বলবেন?
অগত্যা নতুন করে দাবিদাওয়ার তালিকা তৈরি করতে বসেছেন ফ ব নেতারা। নেতাজির পরিবার থেকে তৃণমূল সাংসদ সুগত বসুর সুরেই ফ ব নেতৃত্বও প্রশ্ন তুলছেন, ফাইল যদি প্রকাশ করাই হবে, তা হলে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা কীসের? সেই ফাইল প্রকাশ শেষ হবে কত দিনের মধ্যে? এমন গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা সংসদের আসন্ন অধিবেশনেই বা করা হবে না কেন? মোদী বলেছেন, ডিসেম্বরে রাশিয়া সফরে গিয়ে তিনি রুশ সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন। ফ ব-র দাবি, আমেরিকার কাছেও তথ্য চাইতে হবে। আর ফ ব-র সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাসের পাশাপাশি সিপিএমের প্রকাশ কারাটও প্রশ্ন তুলছেন, নেতাজিকে নিয়ে বিজেপি সরকার যদি এতই আন্তরিক, তা হলে ২৩ জানুয়ারিকে ‘দেশপ্রম দিবস’ ঘোষণার দীর্ঘ দিনের দাবি মেনে নিতে আপত্তি কীসের? যদিও ফ ব-র অন্দরে গুঞ্জন, মোদী সেই দাবি মেনে নিলে আন্দোলনের শেষ রসদটুকুও ফুরিয়ে যাবে!
নাগরিক সম্মেলনের শুরুতে বৃহস্পতিবার দেবব্রতবাবু বলেন, ‘‘কেন বাজপেয়ী জমানায় তৈরি মুখোপাধ্যায় কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণ করা হচ্ছে না? ওই রিপোর্টেই রয়েছে, কতগুলো ফাইল রয়েছে, কোন ফাইলের কোন পৃষ্ঠা নিখোঁজ, কোন ফাইল সরকার দেখাতে চায়নি। নেতাজির ফাইল কোনও পরিবার বা কোনও দলের বিষয় নয়। সকলেরই তাঁর সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার রয়েছে।’’ মোদীর কাছে না হয় সুর চড়িয়ে দাবি তুললেন। কিন্তু মমতার প্রশংসা করবেন না নিন্দা, তা নিয়েই ধন্দে ফ ব নেতারা। এক দিকে ফাইল প্রকাশের জন্য তাঁরা মমতার প্রশংসা করেছেন। আবার বিধানসভা নির্বাচনে মমতা যে নেতাজির আবেগের ফায়দা তুলছেন, যা বামেরা ৩৪ বছরে করেনি, তা বুঝে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনাও করছেন!
এমন সঙ্কটে পড়ে নিঃশব্দে অন্য একটি সিদ্ধান্ত অবশ্য নিয়ে ফেলেছেন ফ ব-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। নেতাজির চেয়ে অনেক বেশি দিন ফ ব-র সর্বময় নেতৃত্বে আছেন অশোক ঘোষ! দলের নেতৃত্ব বদল ও অন্যান্য সাংগঠনিক বিষয়ে আগামী ডিসেম্বরের গোড়ায় দিল্লিতে দলের বিশেষ জাতীয় সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। তার আগে সম্মেলন হতো রাজ্যেও। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচন আসছে, এই কারণ দেখিয়ে সেই বিশেষ সম্মেলন অনির্দিষ্ট কাল পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে!
ফ ব নেতৃত্ব যখন এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তাদের অন্যতম ঘাঁটি কোচবিহারে জমি কেড়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে অন্য দলগুলি! দিনহাটার বিধায়ক উদয়নবাবু চলে গিয়েছেন তৃণমূলে। আবার বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিনই কোচবিহারে দলের জেলা দফতরে বসে দাবি করেছেন, “নেতাজির ফাইল প্রকাশ নিয়ে তৃণমূল ঘৃণ্য রাজনীতি করছে! নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধার হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা নির্বাচনে জিততে চাইছে। আগে কখনও নেতাজির ফাইল প্রকাশের ব্যাপারে ওঁরা দাবি জানাননি!” বাম ও কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়েও কটাক্ষ করেছেন রাহুলবাবু। এবং প্রত্যাশিত ভাবেই দাবি করছেন, মোদী যা করছেন, সেটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে নয়! প্রকৃত ইতিহাসকে তুলে ধরার স্বার্থে।
দেবব্রতবাবুরা আবিষ্কার করছেন, তাঁদের নেতাজি তাঁদের জিম্মা থেকে এখন মোদী-মমতার দলের হাতে হাতেই ঘুরছেন!
No comments:
Post a Comment