দাউদের দেখা নেই। তবে অবশেষে ধরা পড়লেন তাঁর ‘চিরশত্রু’। সেই ‘শত্রুর’ নামেও অবশ্য এ দেশের পুলিশের খাতায় নয় নয় করে ৬৪টি মামলা ঝুলছে!
গত দু’দশক ধরে ইন্টারপোলের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা এহেন ছোটা রাজনকে রবিবার ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া প্রশাসনের দাবি, সিডনি থেকে এসে পৌঁছনোমাত্র তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি যে বালিতে আসছেন, তা ইন্দোনেশিয়া প্রশাসনকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া পুলিশ।
ছোটা রাজনের ধরা পড়াকে ‘বিরাট সাফল্য’ হিসেবে বর্ণনা করে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ইন্দোনেশিয়াকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। রাজনাথ বলেন, ‘‘দীর্ঘকাল ধরে ছোটা রাজনকে ধরতে চেষ্টা করছিল ভারত।’’ তাঁকে দেশে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র। ইন্দোনেশিয়া এ দিন জানিয়েছে, সম্ভবত এই সপ্তাহেই ছোটা রাজনকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে কোনও বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তবে এক দেশে অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্য দেশে ধরা পড়লে তাকে স্বদেশে ফেরানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
ছোটা রাজন। — ফাইল চিত্র
তবে একদা দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী থেকে চরমতম শত্রুতে পরিণত হওয়া ছোটা রাজনকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ দাউদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে কাজে লাগায়, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ছোটা রাজনও দাউদকে দেশের পক্ষে ক্ষতিকর আখ্যা দিয়ে নিজেকে বলেছিলেন ‘দেশপ্রেমিক ডন’!
কেমন সেই ‘দেশপ্রেমের’ নমুনা?
মুম্বইয়ে ১৯৯৩-এর সেই ধারাবাহিক বিস্ফোরণে অভিযুক্তদের কয়েক জন জামিনে ছাড়া পেলেও তাদের খুন করা হয়েছিল এক-এক করে। হানিফ খাদাওয়ালা, আকবর আবু সামা খান, মজিদ খান, শাকিল আহমেদ...। প্রত্যেকেই দাউদ-ঘনিষ্ঠ। প্রতিটি খুনেই অভিযোগের আঙুল উঠেছিল এক জনের দিকে। রাজেন্দ্র সদাশিব নিকালজে। ৫৬ বছর বয়সী ছোটখাটো যে মানুষটিকে দুনিয়া ছোটা রাজন নামে চেনে। ভারতের গোয়েন্দাদের বক্তব্য, মুম্বই বিস্ফোরণে সায় ছিল না রাজনের। প্রাক্তন ‘বস’-এর সঙ্গে তাঁর বিবাদের সেটাই সূত্রপাত।
সেই বিবাদকে ভারত কাজে লাগাচ্ছে বলেও গোয়েন্দা সূত্রে খবর। অনেকে তো এ-ও বলেন যে, মুম্বই বিস্ফোরণ মামলায় জামিনে মুক্তদের খুন করার কাজে ছোটা রাজনকে রীতিমতো মদত দিয়েছিল ‘র’। ছোটা রাজনকে ‘র’ কাজে লাগিয়েছে কি না, তার জবাবে সিবিআইয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা যোগেন্দ্র সিংহ সোমবারই ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বলেছেন, ‘‘কেউ সহায়তা করতে চাইলে আমরা সেটা নিই।’’
তা হলে ছোটা রাজন ধরা পড়লেন কেন?
মুম্বইয়ের প্রাক্তন এবং বর্তমান পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্তাদের অনেকের অভিমত, এই গ্রেফতারি অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পুলিশের নিবিড় সমন্বয়েরই ফসল। ভারতের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে নগণ্য। মহারাষ্ট্র পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘নাম ভাঁড়িয়ে মোহন কুমার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েক বছর ছিলেন ছোটা রাজন। সে দেশে তো বটেই, এমনকী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে চোরাকারবার, কালোবাজারি, জুয়া, দেহব্যবসার জাল বিছিয়েছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার তাগিদ ছিল ওঁকে ধরার। এ ক্ষেত্রে ভারতের আর কী-ই বা করার ছিল?’’
সিবিআইয়ের অবশ্য দাবি, ছোটা রাজনকে ধরার ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছিল। সিবিআইয়ের অধিকর্তা অনিল সিন্হা এ দিন বলেন, ‘‘ইন্টারপোলের মাধ্যমে পাঠানো সিবিআইয়ের অনুরোধেই বালি পুলিশ ছোটা রাজনকে রবিবার বিমানবন্দরে পাকড়াও করেছে।’’ মোহন কুমারের নামে ও নিজের ছবি দিয়ে তৈরি একটি ভারতীয় পাসপোর্টও ছোটা রাজনের কাছে পাওয়া গিয়েছে।
চেম্বুরে তিলকনগরের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে রাজেন্দ্র নিকালজের অপরাধ জগতে হাতেখড়ি সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক আর ছোটখাটো চুরি দিয়ে। এ সব করতে করতেই তিনি রাজন নায়ার ওরফে বড়া রাজনের দলে ঢুকে পড়েন এবং অচিরেই তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই রাজেন্দ্রকে ছোটা রাজন নামে ডাকা শুরু হয়। বড়া রাজন খুন হওয়ার পর সেই গ্যাংয়ের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর উপরে। পরে দাউদের দলে ভিড়ে যান ছোটা রাজন। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ’৯৩-এর বিস্ফোরণের পর দাউদের সঙ্গে ছোটা রাজনের দূরত্ব শুরু এবং তার পর ছোটা শাকিল, শরদ শেট্টিরা ক্রমাগত তাঁর নামে ‘ভাই’-এর কাছে কান ভাঙাতে থাকে। শেষে ‘ডি’ কোম্পানি ছেড়ে নিজের দল তৈরি করেন ছোটা রাজন। এমনকী, দাউদের হাতে তার জীবন বিপন্ন আঁচ করে ১৯৯৬-তে দুবাই ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। অভিযোগ, তখন ছোটা রাজনের মালয়েশিয়ায় নাম ভাঁড়িয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন ভারতেরই গোয়েন্দা কর্তাদেরই একাংশ।
চার বছর পরে, ২০০০-এর সেপ্টেম্বরে ব্যাঙ্ককে ছোটা রাজনের উপরে হামলা চালায় দাউদের লোকেরা। সেই হামলা, রাজনের প্রাণে বাঁচা এবং তার পর হাসপাতাল থেকে উধাও হয়ে যাওয়া— সবই বলিউডের মারকাটারি সিনেমার মতো রোমাঞ্চকর। সে যাত্রা পিৎজা ডেলিভারি বয় সেজে হোটেলের ঘরে ঢুকেছিল বন্দুকবাজরা। ছোটা রাজনের ঘনিষ্ঠ রোহিত বর্মা এবং তাঁর স্ত্রী তাদের গুলিতে মারা গেলেও তিন তলার উপর থেকে লাফ মেরে কোনও মতে প্রাণে বাঁচেন ছোটা রাজন। কোমর ভাঙা অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে।
সে সময় মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার ছিলেন মহেশনারায়ণ সিংহ। এ দিন ফোনে তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘ছোটা রাজনকে গ্রেফতার করতে মুম্বই পুলিশের তিন অফিসারকে ব্যাঙ্ককে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তখন কোমরে বড়সড়় চোট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। হাতেও গুলির ক্ষত ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম, রাজন যখন হাসপাতালে ভর্তি, তখন ধরবই। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আগেভাগে আমাদের টিমের পৌঁছনোর খবর পেয়ে ব্যাঙ্কক পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে তিনি হাসপাতাল থেকে পালান।’’
হাসপাতালের নিরাপত্তা রক্ষীদের ঘুম পাড়িয়ে ছোটা রাজনের ঘরে ঢুকেছিল তাঁর লোকজন। তার পর পাহাড়ে চড়ার যন্ত্রপাতি, দড়িদড়া দিয়ে তাঁকে জানলা দিয়ে নীচে নামিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। শোনা যায় ইউরোপে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছিল ছোটা রাজনের। মহেশনারায়ণ এ দিন বলেন, ‘‘তখনই মনে হয়েছিল, এর মধ্যে গণ্ডগোল রয়েছে। ভারতেরই কেউ কেউ চান না, ছোটা রাজন ধরা পড়ুক। আমি শুনেছি, ভারতের কোনও কোনও গোয়েন্দা সংস্থা রাজনকে ব্যবহার করেছে দাউদের বিরুদ্ধে। আমার কাছে প্রমাণ নেই। তবে আমি অস্বীকারও করতে পারব না।’’ ছোটা রাজনকে ভারতে নিয়ে আসা যাবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন বলেও দাবি মহেশনারায়ণের।
রাজনকে নিয়ে ভারতের গোয়েন্দা কর্তাদের একাংশের সঙ্গে মহারাষ্ট্র পুলিশের বিরোধ বহু পুরনো। মহারাষ্ট্র পুলিশের অনেকেরই দাবি, অন্তত ২০টি খুনের মামলায় জড়িত ছোটা রাজনকে ধরার বহু চেষ্টা শেষ মুহূর্তে বানচাল হয়েছে এক শ্রেণির গোয়েন্দার জন্য। তাঁদের বক্তব্য, ২০১১-র ১১ জুন অপরাধ জগতের খবর করায় বিখ্যাত সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে (জে দে নামেই পরিচিত)-কে গুলি করে খুনের ঘটনায় রাজনই প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তখনও তাঁকে ধরা যায়নি। এক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অফিসারের কথায়, ‘‘ছোটা রাজনের সন্দেহ ছিল, জে দে আসলে দাউদের গ্যাংয়ের হয়ে কাজ করেন এবং সে জন্য ওঁর বিরুদ্ধে লেখেন। এতটাই দাউদ সম্পর্কে রাজনের ঘৃণা। রাজন তো বলেছেন, দাউদ ভারতের মাটিতে পা রাখলেই তাকে তিনি খুন করবেন।’’ অনেকে আবার বলছেন, দাউদকে চ্যালেঞ্জ করা দূরস্থান, তাঁর বাহিনীর চাপে ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন ছোটা রাজন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটা রাজনের লোকবলও কমছে। হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে দাউদ বাহিনী। ছোটা রাজন যে অস্ট্রেলিয়ায় ঘাঁটি গেড়েছেন, সে খবর দাউদের অজানা ছিল না। ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির পরে দাউদের ঘনিষ্ঠতম সঙ্গী ছোটা শাকিল হুমকি দিয়েছিলেন, ছোটা রাজনকে কিছু দিনের মধ্যেই খুন করা হবে। ফলে বিপাকে পড়া ছোটা রাজন ইন্দোনেশিয়ায় ধরা দিয়ে ভারতের আশ্রয়ে নিজের জীবনটা নিরাপদ করলেন কি না, সেই প্রশ্ন থাকছেই।
No comments:
Post a Comment