ক্রমশ। মোদী এবং ওবামা। ওয়াশিংটন ডিসি, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫।
পাঁচ বছর আগে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্ক একুশ শতকের অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই অনন্য সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির রূপান্তরে তার সম্ভাবনার কথা মনে রেখে আমাদের দুই দেশ একটি প্রতিরক্ষাগত ও বাণিজ্যিক কথোপকথন (স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড কমার্শিয়াল ডায়ালগ বা এসঅ্যান্ডসিডি)-এর সূচনা করেছে। এই নতুন বন্দোবস্তটি দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সহযোগিতাকে আরও বিস্তৃত ও গভীরতর করবে এবং তার মাধ্যমে আমাদের দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকার উপর আরও বেশি জোর দেবে।
পৃথিবী এই মুহূর্তে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বহু সমস্যার সম্মুখীন। এই সমস্যাগুলির মোকাবিলায় ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু সে জন্য এই দুই দেশের একসঙ্গে উদ্যোগী হওয়া দরকার, বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করলে হবে না। বৃহৎ এবং বাজারমুখী গণতন্ত্রের অনুসারী এই দুই দেশ ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, বিপুল সামাজিক পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌথ ভাবে কাজ করতে সমর্থ। বৈচিত্র তথা বহুত্বকে রক্ষা করা, পুরনো এবং নতুন নানা আঞ্চলিক সংকটের মোকাবিলা করা এবং আমাদের নাগরিকদের সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা বাড়ানো— বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্রমকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই সামর্থ্যের পরিচয় আমরা দিয়ে চলেছি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সম্পর্ককে আরও জোরদার এবং আরও প্রসারিত করার বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় নেতাদের যৌথ অভিপ্রায় চরিতার্থ করার পথে এসঅ্যান্ডসিডি একটি বড় পদক্ষেপ। ভারত যাতে ‘সাপ্লাই চেন’ অর্থাৎ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের আন্তর্জাতিক কাঠামোর অঙ্গীভূত হতে পারে, আমরা সে জন্য নানা বিষয়ে সহযোগিতার চেষ্টা করছি, যেমন, ব্যবসাবাণিজ্যের পরিবেশে উন্নতিসাধন, পরিকাঠামোর উন্নয়ন, ব্যবসায়িক উদ্যোগ ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রসার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অগ্রগতি। এই চেষ্টা যত বেশি সফল হবে, ভারতে মার্কিন উদ্যোগীদের সামনেও ততই নতুন সুযোগ তৈরি হবে, এবং দু’দেশের প্রতিরক্ষাগত সম্পর্কও জোরদার হবে।
ইতিমধ্যে মার্কিন-ভারত সিইও ফোরামটিকেও জোরদার করে তোলা হয়েছে এবং এই মঞ্চে দু’দেশের বেসরকারি উদ্যোগের পারস্পরিক সংযোগও বেড়েছে। ভারতে শিল্পবাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়ন, স্মার্ট সিটি প্রকল্পে এবং সামগ্রিক ভাবে পরিকাঠামোর প্রসারে বিনিয়োগ, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার সমন্বয়, বিমান পরিবহন ও প্রতিরক্ষা এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মার্কিন উদ্যোগীদের সহযোগিতা খুবই কার্যকর হবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের অঙ্ক পাঁচগুণ বাড়িয়ে বার্ষিক পঞ্চাশ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা দু’দেশের নেতারা স্থির করেছেন, সেটি পূরণ করার জন্য দু’দেশেরই ব্যবসায়ীদের পরামর্শ কাজে লাগবে।
এর পাশাপাশি অন্য নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উন্নতির জন্য, বিশেষত দুনিয়া জুড়ে সুস্থিতি, স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের চেষ্টা চলবে। পৃথিবীর কঠিনতম কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য মার্কিন ও ভারতীয় গবেষকরা একযোগে কাজ করছেন। মার্কিন ও ভারতীয় গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টার সুবাদে গত মার্চ মাসে রোটাভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য সবচেয়ে সস্তা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে কৃষির ফলন ও কৃষিজীবীদের আয় বাড়াতে এবং অপুষ্টি কমাতে আমাদের উন্নয়ন-বিশেষজ্ঞরা কাজ করে চলেছেন। কয়েক মাস আগে নেপালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের বিপর্যস্ত এলাকায় ত্রাণ সরবরাহে আমাদের সেনা ও ত্রাণকর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন। আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত প্রসারিত অঞ্চলের কুড়িটি দেশের সরকারি কর্তারা মা ও শিশুর মৃত্যু কমানোর জন্য গত মাসেই যে অঙ্গীকার করেছেন, আমাদের দু’দেশের সরকার তাতে যোগ দিয়েছে।
রাষ্ট্রের সীমা অতিক্রম করে মহাকাশে এবং সাইবার-দুনিয়াতেও প্রসারিত হয়েছে আমাদের সহযোগিতার উদ্যোগ— রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল আচরণের শর্ত, সাইবার-নিরাপত্তার জন্য সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং মুক্ত, সুরক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য একটি সাইবারস্পেস তৈরির লক্ষ্য পূরণের উপযোগী ইন্টারনেট প্রশাসনের একটি বহুপাক্ষিক কাঠামো নির্মাণের মতো বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা চলছে। মঙ্গলগ্রহে ভবিষ্যৎ অভিযানের নানান কর্মসূচি সহ মহাকাশ গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নাসা এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) যৌথ প্রয়াস উত্তরোত্তর বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটিও সীমান্ত এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্যের গণ্ডিতে বাঁধা নয়। বস্তুত, আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের সামনে এটি একটি বিপুলায়তন সমস্যা। এই সমস্যার মোকাবিলায় আরও বেশি তৎপর হওয়া প্রত্যেকটি দেশের দায়, কারণ জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যেকটি দেশের পক্ষেই এক বড় বিপদ। এই বিপদের মোকাবিলায় আমাদের দুই দেশের যৌথ উদ্যোগ এখন যতটা জোরদার, আগে তা কখনও হয়নি।
ইন্দো-প্যাসিফিক (ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগর) অঞ্চলের একেবারে কেন্দ্রস্থলে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার ফলে যেমন এই দেশের সামনে বিশেষ সুযোগ আছে, তেমনই বিশেষ চ্যালেঞ্জও আছে। গণতন্ত্র, বহুত্ব এবং মুক্ত উদ্যোগের আদর্শে বিশ্বাসী আমাদের দুই দেশ এই অঞ্চলে নিয়মতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক আচরণবিধি অনুসরণের স্বার্থে একযোগে কাজ করতে চায়। আমরা উভয়েই মনে করি, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সুস্থিতির জন্য কিছু শর্ত পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি— যথা, বিভিন্ন দেশের মধ্যে দৃঢ় অর্থনৈতিক সংযোগ, সমুদ্র এবং আকাশপথে এক দেশের এলাকা দিয়ে অন্য দেশের যানের অবাধ চলাচল, এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের মধ্যে সমুদ্র বা ভৌগোলিক এলাকা সম্পর্কিত বিবাদের শান্তিপূর্ণ নিরসনের কার্যকর নিয়মতান্ত্রিক পরিকাঠামো। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দু’দেশের নৌবাহিনী সমুদ্রপথের নিরাপত্তা বিধানে একযোগে কাজ করছে। যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজের প্রযুক্তি ও নকশার ক্ষেত্রে আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। আমাদের নৌবাহিনীর যৌথ অনুশীলন ‘মালাবার’-এর ক্রমশ প্রসার ঘটছে, এ বছর ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান এই অনুশীলনে যোগ দিয়েছে।
আমাদের নাগরিকরাও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার প্রসারে অনন্য ভূমিকা নিয়ে চলেছেন। ২০১৩ সালে দশ লক্ষের বেশি আমেরিকান ভারতে আসেন, আবার গত শিক্ষাবর্ষের হিসেবে এক লক্ষের বেশি ভারতীয় ছাত্রছাত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করছেন। মার্কিন সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের বিরাট অবদান আছে, সিলিকন ভ্যালির বহু নতুন প্রযুক্তি-উদ্যোগের পিছনে আছে তাঁদের প্রতিভা ও উদ্ভাবনী শক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষণাগারে ও লেকচার হল থেকে শুরু করে ফরচুন ৫০০ কোম্পানিগুলির বোর্ডরুমে, ওয়াশিংটনে এবং দেশের নানা রাজ্যে সরকারি উপরমহলে তাঁদের প্রবল উপস্থিতি।
গণতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শ, এক ধরনের মূল্যবোধ, আর্থিক নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য নাগরিকদের প্রবল আকাঙ্ক্ষা— এত বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে মিল রয়েছে! এই আকাঙ্ক্ষাগুলি চরিতার্থ করার জন্য আমরা প্রত্যেকটি স্তরে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার প্রসার ঘটাতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
No comments:
Post a Comment