ক্যাপ্টেন কুল হওয়ার চেষ্টায় ধোনি। রবিবার। বরাবটিতে।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তো এমন ছিলেন না।
হাত দু’টো পিছনে জড়ো করে রাখা। উদাসীন দৃষ্টিতে বরাবাটি গ্যালারিতে কী দেখে চলেছেন, কে জানে। বিরাট কোহলি নেটে ঢুকবেন বলে প্যাড আপ করছেন, প্রায় গোটা টিম চলে গিয়েছে বরাবাটির বাঁ দিকের নেটটায়। অমিত মিশ্র, শিখর ধবন, টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী কে নেই ওখানে? শুধু একজন নেই। এমএসডি নেই এবং তা নিয়ে তাঁর কোনও ভ্রূক্ষেপও নেই। টিম ক্রিকেটীয় কসরতে ব্যস্ত, তিনি পায়চারিতে! যে আনমনা পায়চারি থামে থার্মোকলের এক বড়সড় বাক্সের কাছে। জল-টল যেখানে রাখা থাকে আর কী। কী মনে হল, ওটায় বসলেন একটু। নিস্পৃহ দু’টো চোখ থমকে এ বার সামনে, বাইশ গজ নামের এক আয়তক্ষেত্রের দিকে।
সন্ধের বরাবাটিতে যুগপত্ দু’টো পৃথিবী হাত ধরে দাঁড়িয়ে যেন। একটা বিরাট কোহলি ও টিম ইন্ডিয়ার। আর একটা শুধু তাঁর, এমএসডির। একার।
ভারতীয় ক্রিকেট তার অধুনা সীমিত ওভারের অধিনায়কের মগজাস্ত্রের ব্যাখ্যায় কোন কোন বিশেষণ ব্যবহার করে, সেই চর্বিতচর্বন অর্থহীন। লোকে আজও ডাকে ক্যাপ্টেন কুল। কেউ কেউ রসিকতাও করেন যে ওটা মস্তিষ্ক নয়, চলমান রেফ্রিজারেটর। প্রতিপক্ষের চড়া স্লেজিংয়ে যিনি হাসেন, ক্রিকেটীয় যুদ্ধ জিততে অ-ক্রিকেটীয় মডেল ব্যবহার করেন না বলে ক্রিকেটবিশ্বে প্রবল সমাদৃতও ধোনি। অথচ একই লোক এ দিন ডিজের জগঝম্পতে প্রবল বিরক্ত হয়ে মেজাজ হারালেন। একই লোক হেলমেট আছড়ে ফেলে গরগরে রাগে হাঁটতে থাকলেন ‘অপরাধী’ ডিজের দিকে। আক্রোশে। বিরক্তিতে।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তো এমনও ছিলেন না।
ভারতীয় ক্রিকেটে মরাঠা-রাজ শুরুর দিনে ঠিক এ ভাবেই পাওয়া গেল ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধিনায়ককে। যেখানে এক নয়, সর্বসমক্ষে বেরিয়ে পড়ল তাঁর দ্বৈতসত্ত্বা। প্রথম জন, দৃশ্যত উদাসীন। বিরাট কোহলি নেটের পুরো চার্জ নিয়ে নিয়েছেন দেখেও যেন কিছু আসে যায় না। দ্বিতীয় জন মধ্য তিরিশের রাগী চরিত্র। গান-বাজনা যার এখন অসহ্য লাগছে। দু’জনই অচেনা এবং এমন স্বভাব পরিবর্তনের সঠিক কারণ নির্ণয়ও কঠিন। এটা বোর্ডে পালাবদলের প্রভাব নাকি সীমিত ওভারের সাম্রাজ্যেও কোণঠাসা হয়ে পড়ার হতাশাবিদ্ধ প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করে কে বলবে? শুধু একটা ব্যাপার নিশ্চিত। আভিজাত্যে এবং কৌলিন্যে ভারতের প্রথম পাঁচ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মধ্যে না থেকেও রবিবার ভারতীয় ক্রিকেটের এক বিরল দৃশ্য দেখে নিল বরাবাটি। দেখে নিল বিরল এক ধোনিকে।
এমনিতেই টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরু হতে না হতে ধর্মশালা যা ঘটিয়েছে, ক্যাপ্টেল কুলের মেজাজ ‘হট’ করে দেওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট। তুষার-রাজ্যের রাতের শিশির এবং টিমের পেসারদের মুক্তহস্তে প্রতিপক্ষকে রান ‘উপহার’, প্রায় দু’শো তুলেও টিমকে জিততে দেয়নি। সঙ্গে মিডিয়া। দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসের শেষ ওভার নবাগত শ্রীনাথ অরবিন্দকে দিয়ে করানো থেকে শুরু করে জেপি দুমিনির সামনে বাঁ হাতি স্পিনার অক্ষর পটেলকে ফেলে দেওয়া ভারত অধিনায়কের নানাবিধ ভুল তারা বার করেই চলেছে। ফাফ দু’প্লেসির টিমও সুযোগ বুঝে চিমটি কাটছে। ফারহান বেহারদিন এ দিন বলে গেলেন যে, ভারতের টুঁটি তাঁরা ধর্মশালায় স্রেফ বাঁ হাতি-ডান হাতি ব্যাটিং কম্বিনেশন দিয়ে ছিঁড়ে দিয়েছিলেন! মানে, জে পি দুমিনি আর তিনি নিজে। শুনিয়ে গেলেন, এবি ডে’ভিলিয়ার্সকে দিয়ে ওপেন করানোটা বড়ই কাজ দিচ্ছে। ওপেনে এবি ‘পাওয়ার প্লে’-টা পাচ্ছেন। আর পঞ্চাশ-ষাটটা বল তিনি খেলে দিলে তো কথাই নেই, সেঞ্চুরি ধরাবাঁধা! পরিস্থিতি এমনই যে, প্রতিপক্ষের কথার তিতকুটে ‘কুইনিন’ চুপচাপ দাঁড়িয়ে গিলে নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। কটকের রাতের আকাশ থেকে ধর্মশালার মারাত্মক শিশির নেমে আসবে না ঠিকই। কিন্তু এক-আধটা ভুলচুক বা ওই এবি-র গোটা পঞ্চাশেক বল খেলে ফেলাটা একবার ঘটে গেলেই তো গেল! গঙ্গাবক্ষের স্টেডিয়ামে তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে ঢোকার আগেই তো টি-টোয়েন্টি সিরিজের অক্কাপ্রাপ্তি!
আর এমন অসহ্য আবহে কি না ডিজের কানফাটানো গানবাজনা! ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে বারবার সংগঠকদের বলা হচ্ছিল যে, ওটা থামান। প্লেয়ারদের প্র্যাকটিস করতে অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এবং ডিজের ক্রমর্বধমান জগঝম্পতে এতটাই ক্ষেপে যান ধোনি যে, নেট সেশন অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে আসেন। ব্যাট, হেলমেট মাঠে আছড়ে ফেলে হাঁটতে থাকেন মাঠের অন্য প্রান্তে। প্যাড-গ্লাভস সমেত। কারণ ও দিকেই ডিজে-র আস্তানা। ধোনিকে ও ভাবে যেতে দেখে শাস্ত্রীও দৌড়োলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। ডিজে-কে কড়কানি দিয়ে ফিরে ব্যাট আর হাতে তোলেননি ধোনি। কিট নিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেলেন ভারত অধিনায়ক। দিনের একমাত্র ক্রিকেটীয় খবরটাকে চাপা দিয়ে যে, সোমবার কটকে অমিত মিশ্রর তৃতীয় স্পিনার হিসেবে নামার একটা সম্ভাবনা আছে।
নির্যাসে তা হলে কী?
চলতি ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের দেখা যাচ্ছে, এক নয়, নামকরণ হয়েছে একাধিক। কোথাও লেখা গাঁধী-ম্যান্ডেলা সিরিজ, কোথাও ‘ফ্রিডম সিরিজ’। শুনতে নিষ্ঠুর লাগলেও এটা বাস্তব যে, আদতে এটা এখন ভারত অধিনায়কেরই ‘ফ্রিডম সিরিজ’! যেখানে ক্রিকেট-কারাগারে বন্দি কোনও এক এমএসডিকে বোঝাতে হবে যে, ব্যাটটা তাঁর এখনও চলে। ক্রিকেটীয় ধূর্ততাতে এখনও তাঁর মগজে মরচে পড়েনি। বোঝাতে হবে যে, আজও তাঁর একটাই সত্ত্বা। মেজাজ হারানো নয়, মেজাজ ধরে রাখাটাই তাঁর এক ও অদ্বিতীয় পরিচয়।
সোমবার বরাবাটিতে সিরিজ নির্ণানয় ম্যাচের সঙ্গে এই ‘ম্যাচটা’ও চলবে। এবং দু’টোই সন্ধে সাতটা থেকে।
No comments:
Post a Comment