শুধু সিগারেট নয়। ক্ষতিকর সসেজও! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর দাবি তেমনটাই। ক্যানসারের ঝুঁকি এড়াতে প্রক্রিয়াজাত (প্রসেসড) মাংসকে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে তারা।
সিগারেটের প্যাকেটে যেমন ক্যানসারের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক, এ বার ওই ধরনের প্যাকেটবন্দি খাবারের ক্ষেত্রেও তা চালু করা যায় কি না, সে ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বলছেন, শুধু সসেজ-বেকন-সালামি নয়, যে কোনও ধরনের খাবার যা সংরক্ষণের জন্য বিশেষ রাসায়নিক (প্রিজার্ভেটিভ) ব্যবহার করা হয়, তাকে এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
চিকিৎসকদের মতে, ক্যানসারের ইতিবৃত্ত এখনও রহস্যে ঠাসা। তাই বহু ক্ষেত্রেই নানা সাবধানতা নেওয়া সত্ত্বেও আচমকা রোগটা থাবা বসায় শরীরে। কিন্তু যে সব ক্ষেত্রে বিপদগুলো জানা, ঝুঁকির দিকগুলোও বহু আলোচিত, সেই সব ক্ষেত্রেও কি সতর্ক থাকছেন সাধারণ মানুষ? ক্যানসারকে বহুলাংশেই ‘লাইফ স্টাইল ডিজিজ’ বলে চিহ্নিত করার পরেও কি সম্বিৎ ফিরছে কারও?
চিকিৎসকরা বলছেন, ফিরছে না। আর তাই প্রক্রিয়াজাত খাবারের এমন রমরমা বাজারে। বহু পরিবারেই সকালের খাবারে বা ছোটদের স্কুলের টিফিনে প্রক্রিয়াজাত মাংসের নানা পদ জায়গা করে নেয় প্রায় রোজই। চিকিৎসকদের মতে, এমনিতেই ‘রেড মিট’ নিয়মিত খাওয়া ঠিক নয়, তার ওপরে প্যাকেটবন্দি রেড মিটের সসেজ বা বেকন আরও ক্ষতিকর।
কেন? বায়োকেমিস্ট্রির বিশেষজ্ঞ কৃষ্ণজ্যোতি গোস্বামী জানান, বহু খাবার সংরক্ষণের জন্য (প্রিজার্ভেটিভ) বিউটিলেটেড হাইড্রক্সিটলুয়েন এবং বিউটিলেটেড হাইড্রক্সিঅ্যানিসোল নামে দুই রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। এই রাসায়নিকগুলি জিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা থেকে ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘খাবার সংরক্ষণের জন্য সোডিয়াম ওমাডিন নামে একটি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যার জেরে শরীরে ট্রান্সফ্যাট জমার প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে যায়। ট্রান্সফ্যাট হল এমন ধরনের ফ্যাট যাকে পোড়ানো যায় না। শরীরের পক্ষে এটি খুবই বিপজ্জনক। তার ওপরে প্রসেসড ফুড বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের মোড়কে থাকে। সোডিয়াম ওমাডিন সেই প্লাস্টিক থেকে কার্সিনোজেনিক বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থগুলিকে বার করে খাবারে মিশতে সাহায্য করে।’’
একই ব্যাখ্যা বায়োকেমিস্ট্রির চিকিৎসক শান্তা সাহা রায়েরও। তিনি বলেন, ‘‘খাবার সংরক্ষণের রাসায়নিকগুলি শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। আবার রেড মিট-ও ক্ষতিকর। ওই দু’টি যদি একসঙ্গে মেশে তা হলে তার ফল হতে পারে ভয়াবহ।’’
এবং সেটাই হচ্ছে। ব্রেকফাস্টে পর্ক সসেজ, বোতলবন্দি ফলের রস, দুপুরে হ্যাম স্যান্ডউইচ কিংবা বার্গার, সঙ্গে এনার্জি ড্রিঙ্ক। হালফিলের কর্পোরেট জীবনের সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যায়। ফাস্ট ফুডে মজে থাকা শিশুদের কাছেও এই মেনু দারুণ পছন্দের। সহজলভ্য। বাড়িতে রান্না করার ঝামেলাও নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্যাকেটবন্দি এই সব আমিষ খাবার এক-আধ দিন চলতে পারে। কিন্তু নিয়মিত এ সব খাওয়ার অর্থ রোগকে আদর করে ঘরে ডেকে আনা।
ক্যানসার চিকিৎসকরা মনে করছেন, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সিগারেট এবং মদকে যে ভাবে ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, ঠিক সে ভাবেই প্রক্রিয়াজাত মাংসকেও শত্রুতালিকায় ঢোকানো উচিত। ক্যানসার চিকিৎসক অনুপ মজুমদার বলেন, ‘‘নুন এবং তার সঙ্গে অন্য নানা রাসায়নিক মিশিয়ে খাবার সংরক্ষণ করা হয়। প্রোটিনের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সংরক্ষণের জন্য যা যা ব্যবহার করা হয়, তা একক ভাবে হয়তো ততটা ক্ষতিকর নয়, কিন্তু একসঙ্গে তা খুবই বিপজ্জনক।’’ একই বক্তব্য ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়েরও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কাবাব খেতে বারণ করি, কারণ মাংস পোড়ানোর সময়ে যে রাসায়নিক তৈরি হয় তা থেকে ক্যানসার হতে পারে। প্রক্রিয়াজাত মাংসের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এর কোনওটাই মাঝেমধ্যে খেলে সমস্যা নেই। টানা বহু বছর যদি কেউ খেয়ে যান, তা হলে সমস্যার ঝুঁকি ষোলো আনা।’’
খাওয়াদাওয়ার ভুল অভ্যাস এবং নিয়মিত শরীরচর্চার অভাবে স্থূলত্বের সমস্যা ঊর্ধ্বমুখী। ইতিমধ্যেই একে ক্যানসারের কারণ হিসেবে দায়ী করেছে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার সময় এসে গিয়েছে। সময় বাঁচাতে এবং মুখরোচক হিসেবে যা যা খাওয়া হচ্ছে, তা শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর তা বিচার করতেই হবে। অন্যথায় বড় বিপদ আসবে। ক্যানসার সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা, কিন্তু যেটুকু জানা, সে ব্যাপারে আমরা কেন সতর্ক হব না?’’
ডায়েটিশিয়ান রেশমী রায়চৌধুরীও জানিয়েছেন, এমন নানা ঝুঁকির কথা ভেবেই প্রসেসড ফুড থেকে দূরে থাকার পরামর্শই দেন তাঁরা। তিনি জানান, নিরামিষ খাবার সংরক্ষণে যে ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয়, আমিষ (অ্যানিম্যাল প্রোটিন) সংরক্ষণে ব্যবহৃত রাসায়নিক তার চেয়ে অনেক বেশি কড়া এবং ক্ষতিকর। এগুলি নিয়মিত খেলে বার্ধক্য আসে, ক্যানসারের ঝুঁকিও বেড়ে় যায়। তিনি বলেন, ‘‘এমনিতেই পরিবেশ দূষণের প্রভাব মারাত্মক। সেটা আমরা চাইলেও পুরোটা ঠেকাতে পারি না। কিন্তু খাওয়াদাওয়ায় রাশ টানার ব্যাপারটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেটুকু তো করাই উচিত।’’