সময়টা যেন কাটতেই চাইছে না! উত্তেজনা-উৎকণ্ঠায় টগবগ করে ফুটছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)।
কারণ, অ্যাস্ট্রোস্যাট। দেশীয় প্রযুক্তিতে ভারতের তৈরি কৃত্রিম উপগ্রহ। সব ঠিকঠাক চললে কাল, সোমবার সকাল দশটায় অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ কেন্দ্র থেকে পিএসএলভি রকেটে সওয়ার হয়ে যে অভিযানে রওনা দেবে। ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর-সহ ব্রহ্মাণ্ডের বিবিধ রহস্য সন্ধানের ভার বর্তেছে দেড় হাজার কিলোগ্রামের উপগ্রহটির উপরে। আগামী পাঁচ বছর সে ক্ষণিকের জন্যও দায়িত্ব সম্পাদনে বিরতি দেবে না।
অর্থাৎ কিনা, মহাকাশে ভারতের পর্যবেক্ষণকেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে অ্যাস্ট্রোস্যাট। তার সঙ্গে একই রকেটে চাপিয়ে কয়েকটি বিদেশি উপগ্রহকেও কক্ষপথে পাঠানো হচ্ছে। যার বিনিময়ে উপার্জনের বড় উৎসও খুলে যাচ্ছে ইসরো’র সামনে।
এ হেন ‘মহা অভিযানের’ কাউন্টডাউন শনিবার রাতে শুরু হয়ে গিয়েছে শ্রীহরিকোটায়। মহাকাশবি়জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা গবেষণার যে বিপুল ক্ষেত্র, সোমবারের উৎক্ষেপণ সফল হলে ভারত সেখানে প্রথম বড় পদক্ষেপ করবে বলে ইসরো-কর্তাদের দাবি। এর আগে আমেরিকা (সঙ্গী ইউরোপীয় ইউনিয়ন), রাশিয়া ও জাপান এমন গবেষণায় হাত দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে তালিকায় ভারত হবে চতুর্থ দেশ। এই জাতীয় গবেষণার তাগিদেই মার্কিন গবেষণাসংস্থা নাসা মহাকাশে হাবল টেলিস্কোপ পাঠিয়েছে। ‘‘সেই বিচারে অ্যাস্ট্রোস্যাট যেন ভারতীয় হাবল।’’— মন্তব্য এক বিজ্ঞানীর। ইসরো-র উদ্যোগটির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে দেশের তাবড় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানও। যেমন পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইইউকা) ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স। প্রসঙ্গত, তাত্ত্বিক মহাকাশ গবেষণার সূত্রে ইসরো’র চেয়ারম্যান এএস কিরণকুমার দিন কয়েক আগে বলেছিলেন, ‘‘ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য সন্ধানে অ্যাস্ট্রোস্যাট হবে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের নিজস্ব হাতিয়ার।’’
হাতিয়ারকে ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জেই আপাতত বুঁদ হয়ে রয়েছেন প্রযুক্তিবিদেরা। কী অবস্থা আজ শ্রীহরিকোটায়?
চেন্নাইয়ে ইসরো-র অস্থায়ী অফিসের বাইরে কথা হচ্ছিল সংস্থার মুখপাত্র বিআর গুরুপ্রসাদের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ৪৪ মিটার লম্বা, ৩২০ টন ওজনের পিএসএলভি সি-৩০ রকেটটির মোট চারটে ধাপ (স্টেজ)। প্রথম ও তৃতীয় স্টেজে কঠিন জ্বালানি আগেই ভরা হয়ে গিয়েছে। রবিবার সকালে শুরু হয়েছে দ্বিতীয়-চতুর্থ ধাপে তরল জ্বালানি (প্রপালশন ফুয়েল) ভরার কাজ।
গুরুপ্রসাদ যখন এ কথা বলছেন, তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। বিকেলে খবর এল, জ্বালানি ভরা শেষ। রকেট ও উপগ্রহের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাও সারা।
অতএব, এখন শুধু চূড়ান্ত মুহূর্তের প্রহর গোনা। যাত্রা-নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, কাল ঠিক সকাল দশটায় মহাকাশ ফুঁড়ে ওড়ার বাইশ মিনিটের মধ্যে অ্যাস্ট্রোস্যাটকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে দেবে পিএসএলভি। তার পরে উপগ্রহের রাশ চলে যাবে বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদদের হাতে। বেঙ্গালুরুতে ইসরো’র টেলিমেট্রি, ট্র্যাকিং অ্যান্ড কম্যান্ড নেটওয়ার্ক সেন্টার (ইসট্র্যাক)-এর মিশন অপারেশন কমপ্লেক্সে (মক্স) বসে যাঁরা তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করবেন।
এবং ওঁদের হাত ধরেই আগামী পাঁচ বছর ধরে মহাকাশে চক্কর কাটতে কাটতে ব্রহ্মাণ্ডের অসীম রহস্যের আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা চালাবে অ্যাস্ট্রোস্যাট। কী ভাবে?
ইসরো-সূত্রের খবর: মহাজাগতিক কাজ-কারবার খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণের স্বার্থে অ্যাস্ট্রোস্যাটে পাঁচ-পাঁচটা ‘চোখ’ বসানো হয়েছে। তার অন্যতম, ৪০ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি টেলিস্কোপ। মাঝারি ক্ষমতার এক্স-রে চিহ্নিত করার জন্য থাকছে ‘লার্জ এরিয়া জেনন প্রোপোরশনাল কাউন্টার।’ সঙ্গে কম ক্ষমতার এক্স-রশ্মি সন্ধানী টেলিস্কোপ। উচ্চ শক্তির এক্স-রে ছবি ধরতে রয়েছে একটি ‘ক্যাডমিয়াম জিঙ্ক টেলুরাইড কোডেড মাস্ক ইমেজার।’ তাল মিলিয়ে মহাবিশ্বে এক্স-রশ্মির উৎস খোঁজা হবে স্ক্যানিং স্কাই মনিটর (এসএসএম) মারফত। আইইউকা এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষকদের বক্তব্য, ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে কোনও এক ধরনের রশ্মি চিহ্নিত করাটাই যথেষ্ট নয়। তাই এত আয়োজন।
অন্য দিক দিয়েও অ্যাস্ট্রোস্যাট প্রকল্প কিছুটা অভিনব। কারণ, ইসরো এতে গবেষণা-অভিযানের পাশাপাশি বাণিজ্যকেও জুড়ে ফেলেছে। অ্যাস্ট্রোস্যাটের সঙ্গেই পিএসএলভি রকেটে চাপানো হচ্ছে ছ’টি বিদেশি কৃত্রিম উপগ্রহকে— আমেরিকার চারটে, কানাডার একটা ও ইন্দোনেশিয়ার একটা। তাদের কক্ষপথে পোঁছে দেওয়ার বরাত পেয়েছে ইসরো। মহাকাশ পাড়ির রকেটে লিফ্‌ট দেওয়ার ভাড়া তো নেহাত কম নয়!
গবেষণার সঙ্গে তাই আয়ের নতুন পথও খুলে দিচ্ছে অ্যাস্ট্রোস্যাট।