সাড়ে তিন বছর পরে প্রথম সাফল্য গজলডোবায়। দু’টি বাজেট হোটেল এবং একটি স্টার হোটেল তৈরির জন্য তিনটি সংস্থা প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে রাজি হয়েছে। গত সোমবার অর্থ দফতর এ সংক্রান্ত দরপত্র চূড়ান্ত করেছে বলে নবান্ন সূত্রের খবর।
উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে ২০১২ সালের গোড়ায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গজলডোবাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর সাধের প্রকল্পের নাম দিয়েছিলেন ‘ভোরের আলো’। কিন্তু তার পর থেকে বার বার চেষ্টা করেও ওই পর্যটন প্রকল্পে কোনও লগ্নি টানতে পারেনি রাজ্য। শেষ পর্যন্ত খরা কাটছে।
পর্যটন, পূর্ত, জনস্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ এবং বন দফতরের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকল্পটি যাতে দিনের আলো দেখে সে ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে ভার দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘পাঁচটি দফতরের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে গজলডোবায় পরিকাঠামো গড়ে তোলা গিয়েছে। রাস্তা, জল, বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লগ্নি-গন্তব্যের উপযুক্ত করে সাজিয়ে তোলায় বিনিয়োগকারীরা আসতে শুরু করেছেন।’’
কী হতে চলেছে গজলডোবায়?
অর্থমন্ত্রী জানান, আপাতত দু’টি বাজেট হোটেল এবং একটি স্টার হোটেলের জন্য তিনটি সংস্থা আসছে। এদের মধ্যে টু-স্টার হোটেলটি তৈরি করবে স্টার্লিং গোষ্ঠী। পর্যটন সংস্থা টমাস কুকের অধীনে থাকা স্টার্লিং গোষ্ঠী এ দেশে ২২টি বিলাসবহুল স্টার-রিসর্ট চালায়। এ ছাড়া দু’টি বাজেট হোটেল তৈরিতে সম্মত হয়েছে সামিট গোষ্ঠী এবং শীল গোষ্ঠী। এই দুই সংস্থারও হোটেল ব্যবসা, চা-বাগানে পর্যটন কেন্দ্র চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। অর্থমন্ত্রীর দাবি, শুধু এই তিনটি হোটেল হলেই বছরে ১ লক্ষ পর্যটক গজলডোবায় আসবে। প্রায় ১,১০০ জনের কর্মসংস্থান হবে। এবং এ থেকে প্রায় ৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রকল্পটির চেহারা কেমন হবে?
নবান্নের কর্তারা জানাচ্ছেন,  তিস্তা ব্যারাজের তীরে ২৮০ একর জুড়ে ত্রিভুজের মতো এলাকা নিয়ে গড়ে উঠছে গজলডোবা পর্যটন কেন্দ্র। যার এক দিকে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল। অন্য দুই দিকে তিস্তা ব্যারাজ ও তিস্তা খাল। তিস্তা ব্যারাজের ধারে দাঁড়ালেই নজরে আসে বিস্তীর্ণ হিমালয়। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল ও মূল পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় ৭৫ একর এলাকা জুড়ে তৈরি হবে ‘বাফার জোন’ এবং নাইন হোল গল্ফ কোর্স। বাকি এলাকা জুড়ে থাকছে আয়ুর্বেদিক স্পা, বিনোদন পার্ক, বটানিকাল গার্ডেন, টাওয়ার রেস্তরাঁ, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং লেক-রিসর্ট। পর্যটকদের থাকার জন্য মোট তিনটি বাজেট হোটেল, দু’টি বিলাসবহুল হোটেল এবং একটি করে তিন, চার ও পাঁচ তারা  হোটেল হওয়ার কথা। পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে ১৮ একর এলাকা জুড়ে একটি জলাশয়ও রয়েছে। ওই জলাশয়কে কেন্দ্র করেই গড়ে তোলা হবে লেক-রিসর্ট এবং টাওয়ার-রেস্তোরাঁ।
শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য রয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। শিশুদের জন্য থাকবে বিশেষ বিনোদন পার্ক। আর প্রবীণেরা যাতে অবসর জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে জল-জঙ্গল-পাহাড়ে ঘেরা মনোরম পরিবেশে কিছু দিন কাটিয়ে যেতে পারেন, সে জন্য থাকছে বিশেষ বৃদ্ধাবাস।
সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী, শীতকালে গজলডোবায় প্রায় ১৫ হাজার পরিযায়ী পাখি আসে। এই পর্যটন কেন্দ্র থেকে গাড়িতে এক থেকে সোয়া ঘণ্টা গেলেই ৭টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। পর্যটকেরা যাতে পাখি দেখতে পারেন, তার জন্য গজলডোবার তীর জুড়ে থাকবে ‘বার্ড ওয়াচ টাওয়ার’। ওই টাওয়ার থেকে দেখা যাবে হিমালয়ও। আর পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যেই রাখা থাকবে তিনটি হাতি। পুরো এলাকাটাই হবে পরিবেশ-বান্ধব। যে কারণে, পর্যটন কেন্দ্রের ভিতরে যাতায়াতের জন্য থাকবে ব্যাটারিচালিত গাড়ি।
শিলিগুড়ি থেকে গজলডোবা পৌঁছে যাওয়া যায় আধ ঘণ্টায়। পথে একটি রক্ষীবিহীন লেভেল ক্রসিং আছে। সেখানে রক্ষী রাখার খরচ রাজ্য বহন করতে পারে।
তিনটি হোটেল দিয়ে ‘ভোরের আলো’র যাত্রা শুরু হলেও অর্থমন্ত্রীর আশা, দু’-তিন বছরের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ প্রকল্পটি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হলে উত্তরবঙ্গে পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে এই গজলডোবা। অর্থমন্ত্রীর হিসেব, প্রকল্পটি পুরো আকার পেলে ৮ হাজার জনের কর্মসংস্থান হবে ও রাজ্যের ঘরে কয়েকশো কোটি টাকা রাজস্ব আসবে।