বারবার তিন বার। ইন্টারনেট নিয়ে ফের হাত পুড়ল নরেন্দ্র মোদী সরকারের।
প্রথম ধাক্কা ছিল নেট-নিরপেক্ষতা নিয়ে। সংসদে দাঁড়িয়ে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদকে বলতে হয়েছিল, মোদী সরকার ইন্টারনেটের নিরপেক্ষতার পক্ষে। এর পর পর্নোগ্রাফির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেও পিছু হটতে হয়েছিল। তৃতীয় ধাক্কা এল আজ। হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার বা ফেসবুকে মেসেজ চালাচালিতে নজরদারির খসড়া নীতিটি গত কালই প্রকাশ করেছিল তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক। আরও এক বার দেশজোড়া সমালোচনার মুখে পড়ে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সেটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হল তারা।
কী ছিল ওই খসড়া প্রস্তাবে?
তাতে বলা হয়েছিল, জি-মেল, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল সাইট বা চ্যাট ফোরামে চালাচালি করা ব্যক্তিগত মেসেজও ইচ্ছে করলেই কেউ মুছে ফেলতে পারবেন না। তা ৯০ দিন রেখে দিতে হবে। চাইলে গোয়েন্দা সংস্থাকেও ওই মেসেজ দেখাতে হবে। মন্ত্রকের তরফে অবশ্য বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল, এটি শুধুই খসড়া প্রস্তাব। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের তীব্র অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। মার্কিন সরকারের মতো নজরদারির মনোভাব নিয়ে মোদী প্রশাসনও চলছে বলে অভিযোগ করেন কেউ কেউ।
আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় এ বিষয়ে আলোচনার পর রবিশঙ্কর প্রসাদ জানান, ওই খসড়া নীতি বিশেষজ্ঞরা তৈরি করেছিলেন। তা সরকারের চূড়ান্ত অবস্থান নয়। কার্যত রিপোর্টের দায় ঝেড়ে ফেলে মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমারও মনে হয়েছে, যে ভাবে লেখা হয়েছে তাতে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। আমি তাই এই খসড়া নীতি প্রত্যাহার করে নতুন করে লিখতে বলেছি।’’ তিনি জানান, পর্যালোচনার পরে নতুন খসড়া নীতি প্রকাশ করা হবে। কিন্তু কবে তা প্রকাশ করা হবে, তিনি বলতে চাননি। ফলে গোটা বিষয়টাই হিমঘরে চলে গেল কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষত সামনেই যখন ভোটের মরসুম।
নজরদারির বিষয়টি কী রকম?
হোয়াটসঅ্যাপ বা জি-মেলে বার্তা যায় একটি সাঙ্কেতিক মোড়কের মধ্য দিয়ে। ধরা যাক, কেউ লিখলেন, ‘কেমন আছো?’ তিনি ‘সেন্ড’ বোতাম ছোঁয়া মাত্রই এই লেখাটি ডট, হ্যাশ, ব্র্যাকেট ইত্যাদি-সহ একটি সাঙ্কেতিক কোডের চেহারা নেবে। গ্রাহকের মোবাইলে পৌঁছে সেই কোড আবার হয়ে যাবে ‘কেমন আছো?’ মাঝের এই সাঙ্কেতিক অংশটুকুতে নজরদারির কোনও সুযোগ কার্যত নেই গোয়েন্দাদের। এখানেই বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, একেবারেই নজরদারি না থাকাটা দেশের নিরাপত্তার পক্ষে ঠিক নয়। বিশেষ করে যখন ই-গভর্ন্যান্সের যুগে ইন্টারনেটে নানা রকম সরকারি পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। ই-কমার্সেও বাড়ছে বেচাকেনা। সেই কারণেই এই ‘ন্যাশনাল এনক্রিপশন পলিসি’ তৈরি জরুরি (যার একটি অংশ হল চ্যাট বা সোশ্যাল সাইটে নজরদারি)। অনলাইনে সরকারি পরিষেবার টাকা জমা দিতে গিয়েও কেউ হ্যাকারের কবলে পড়তে পারেন। কিন্তু নজরদারি ব্যবস্থা থাকলে কোন আইপি অ্যাড্রেস থেকে কে লেনদেন করলেন, তারও হদিস পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু এখানেই এসে পড়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন। আজ সকালেও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক যুক্তি দিয়েছিল, সোশ্যাল মিডিয়া এই নীতির আওতায় পড়বে না। ব্যাঙ্কের লেনদেন, পাসওয়ার্ড দিয়ে নেটে কেনাকাটাতেও নজরদারি করা হবে না। তাতেও ক্ষোভ কমেনি। শেষে খসড়া নীতিটি পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
সেন্টার ফর ইন্টারনেট অ্যান্ড সোসাইটি-র পলিসি ডিরেক্টর প্রাণেশ প্রকাশের মতে, গোটা খসড়া নীতিটিতেই অস্পষ্টতা ছিল। তাঁর কথায়, ‘‘মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেম, অর্থাৎ উইন্ডোজ বা অ্যান্ড্রয়েডকে কি নজরদারি ব্যবস্থার বাইরে রাখা হতো? খসড়া দেখে তেমন তো মনে হচ্ছে না। (সার্বিক ভাবে) সেখানেই যদি সরকারের নজরদারি চলে, তা হলে শুধু ‘সোশ্যাল মিডিয়া বাইরে রয়েছে’ বলে কী লাভ?’’ অনেকে মনে করছেন, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে কোনও নীতি তৈরির আগে সরকারই আসলে মনস্থির করতে পারছে না। খসড়া নীতিটি দেখে যে সমালোচনার ঝড় উঠবে, তা আগেই বোঝা উচিত ছিল। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ নিখিল পাওয়া-র প্রশ্ন, ‘‘সব কিছুকেই কি দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া জরুরি?’’
তবে বোমাটা ফাটিয়েছেন কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সূর্যেওয়ালা। তিনি বলেছেন, ‘‘এই সরকারের মানসিকতাই হল গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারির। এর পর সরকার বলবে, আপনি শোওয়ার ঘরে কী করছেন, তা-ও রেকর্ড করে ৯০ দিন পর্যন্ত তা রেখে দিতে হবে!’’