এ বার হিরোশিমার বদলা! ৭০ বছর পর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’- এই দুই পরমাণু বোমার আঘাতে কার্যত, ‘অ্যানাইহিলেশান’ বা ধ্বংস চাক্ষুষ করেছিল হিরোশিমা, নাগাসাকি।
৭০ বছর পর আরও একটি ‘অ্যানাইহিলেশান’-এর প্রস্তুতি, তোড়জোড় শুরু হচ্ছে জাপানে। আগামী জানুয়ারিতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আর প্রায় গোটা ইউরোপের কাছে হার মানতে হয়েছিল জাপানকে।
৭০ বছর পর একেবারেই অন্য রকমের একটি ধ্বংসের প্রস্তুতিতে নেমে আমেরিকা, জার্মানি ও ইউরোপের অন্য দেশগুলিকে এ বার টেক্কা দিতে চলেছে জাপান!
জেনিভার অদূরে, সার্নের ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের (এলএইচসি) ‘একনায়কত্বে’র দিন ফুরচ্ছে! গড়ে উঠতে চলেছে আরও দীর্ঘ- ৫১ কিলোমিটারের আন্তর্জাতিক লিনিয়ার কোলাইডার বা আইএলসি। যাতে কণা (পার্টিকল) ও প্রতি-কণার (অ্যান্টি-পার্টিকল) মধ্যে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ ঘটানো হবে। সার্নের এলএইচসি-তে প্রোটন কণাদের মধ্যে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ ঘটানো হচ্ছে বৃত্তাকার পথে। আর জাপানে প্রস্তাবিত নতুন সুড়ঙ্গ গবেষণাগারে কণাদের মধ্যে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ ঘটানো হবে সরলরৈখিক পথে। তাই ওই যন্ত্রদানবের নাম দেওয়া হয়েছে লিনিয়ার কোলাইডার।
লিনিয়ার কোলাইডারের ম্যাগনেটিক টিউবের টেস্ট মডেল।
আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া- এই তিনটি মহাদেশের কণা পদার্থবিদ্যা গবেষণার সবকটি শীর্ষ সংস্থাকে নিয়ে ২০০৬ সালে গড়ে উঠেছিল যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সেই ‘গ্লোবাল ডিজাইন এফর্ট’ (জিডিই)-এর উদ্যোগেই উত্তর জাপানের কিতাকামি পার্বত্য এলাকায় শুরু হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সুড়ঙ্গ গবেষণাগার নির্মাণের কাজ। প্রথম পর্যায়ে ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ গবেষণাগার বানানো হবে। বাকি ২০ কিলোমিটারের কাজ মঙ্গলে মানুষের পা ফেলার আগেই শেষ হয়ে যাবে।
অধুনা আমেরিকার ‘ফার্মি ল্যাব’-এ গবেষণারত, কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের হাই এনার্জি নিউক্লিয়ার অ্যান্ড পার্টিকল ফিজিক্সের (এইচইএনপিপি) ভূতপূর্ব প্রধান সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ই মেলে জানিয়েছেন, ‘‘এই মহাযজ্ঞের বাজেটও আকাশ ছোঁয়া। বাজেট বরাদ্দের নিরিখে সার্নের এলএইচসি-কে তো ছাড়িয়ে গিয়েইছে আইএলসি, বিশ্বে সর্বাধিক ব্যয়ের বিজ্ঞান গবেষণা প্রকল্পের তালিকায় আইএলসি-র স্থান চার নম্বরে। সেই অর্থে, কণা পদার্থবিদ্যার গবেষণায় আইএলসি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে চলেছে। আইএলসি-তে ৫০ হাজার কোটি ইলেকট্রন ভোল্ট পর্যন্ত শক্তি উৎপন্ন করা যাবে। ওই শক্তিকে আরও বাড়িয়ে এক ট্রিলিয়ান ইলেকট্রন ভোল্ট (টিইভি) করার প্রযুক্তিও থাকবে আইএলসি-তে। আইএলসি-র ভেতরের তাপমাত্রা হবে একেবারেই হিমশীতল। মাইনাস ২৭১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৪৫৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট।’’
এলএইচসি-র সঙ্গে আইএলসি-র ফারাকটা হবে কোথায় কোথায়?
সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের হাই এনার্জি নিউক্লিয়ার অ্যান্ড পার্টিকল ফিজিক্সের বিজ্ঞানী সাত্যকি ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, ‘‘ফারাকটা প্রথমত হবে দৈর্ঘ্যে। আইএলসি-তে মৌল কণাদের মধ্যে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ ঘটানো হবে এলএইচসি-র দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যের পথে। দ্বিতীয় ফারাকটা পথের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। এলএইচসি-তে কণাদের ছোটানো হয় বৃত্তাকার পথে। কিন্তু লিনিয়ার কোলাইডারে তাদের ছোটানো হবে সরলরৈখিক পথে। এলএইচসি-তে তুলনায় অনেক ভারী কণাদের মধ্যে সঙ্ঘর্ষ ঘটানো হচ্ছে। আর লিনিয়ার কোলাইডারে অনেক হাল্কা ঋণাত্মক আধানের ইলেকট্রনের সঙ্গে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ ঘটানো হবে তার অ্যান্টি-পার্টিকল ধনাত্মক আধানের পজিট্রনের। যাকে আক্ষরিক অর্থেই বলে ‘অ্যানাইহিলেশান’ বা ধ্বংস।’’
কোলাইডারের দু’টি ডিটেক্টর।
কোন কোন বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে লিনিয়ার কোলাইডারে, যা এলএইচসি-তে নেই?
মার্কিন ‘ফার্মি ল্যাব’-এর বিজ্ঞানী সুনন্দবাবু ই মেলে জানাচ্ছেন, ‘‘পৃথিবীতে কোনও সুড়ঙ্গ গবেষণাগারে কৃত্রিম ভাবে আমরা কত বেশি পরিমাণ শক্তির জন্ম দিতে পারি, লিনিয়ার কোলাইডার অনেকটা ‘টেলিস্কোপে’র মতো অনেক আগেই তা মাপতে সাহায্য করবে। এলএইচসি-র চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ শক্তি লিনিয়ার কোলাইডারে উৎপন্ন করা যাবে বলে উচ্চ শক্তিতে এখনও ব্রহ্মাণ্ডের অজানা, অচেনা, অধরা বহু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার হদিশ মেলার সম্ভাবনা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যাবে। তা ছাড়াও ‘বিগ ব্যাং’য়ের পরপরই কী পরিমাণ শক্তিতে ব্রহ্মাণ্ডের মূল চারটি বল একত্রিত (Unified) ছিল, তা মাপতেও লিনিয়ার কোলাইডার অনেক বেশি সহায়ক হবে।’’
লিনিয়ার কোলাইডার আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষকে কী কী সুবিধা দিতে পারে?
লিনিয়ার কোলাইডারের মোট পথের নকশা
সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধ্যাপক সাত্যকি ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, ‘‘চিকিৎসাবিজ্ঞান, কম্পিউটার প্রযুক্তি ও পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে লিনিয়ার কোলাইডার। আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কোষ-কলায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিপথ বোঝার কাজটা এই কোলাইডার অনেক বেশি সহজ করে দেবে ‘পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি’র (পেট) মাধ্যমে। টিউমার অপারেশনকেও সহজতর করে তুলবে। কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন পদ্ধতিকে সহজতর করবে। তা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের ‘রেডিয়েশন থেরাপি’তে রোগীর কোষ-কলায় এখন যে ক্ষতিটা হয়, তা অনেকটাই কমিয়ে দেবে। কম্পিউটার প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তা ডেটা ট্রান্সফারের হারকে কয়েক গুণ বাড়াবে। ম্যামো গ্রিড ডেটা বেসকে আরও উন্নত করবে। এর পাশাপাশি, পারমাণবিক বর্জ্যকে ক্ষতিকর নয় এমন পদার্থে বদলে দেওয়ার কাজটাও অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে লিনিয়ার কোলাইডারের গবেষণায়।’’
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ‘অ্যানাইহিলেশান’ আক্ষরিক অর্থেই ছিল ধ্বংস, জাপানে এ বার কিন্তু তা ঘটানো হচ্ছে সৃষ্টির তাগিদেই!
No comments:
Post a Comment