রঞ্জি মরসুমের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটা ঘটে গেল বৃহস্পতিবার। দীর্ঘ সতেরো বছর বাংলার হয়ে খেলার পর বাংলার রঞ্জি টিম থেকে লক্ষ্মীরতন শুক্লকে বাদ দিয়ে দিল সিএবি। এই প্রথম। ফিট থাকা সত্ত্বেও, বাংলার দীর্ঘ দিনের অন্যতম সেরা যোদ্ধা হওয়া সত্বেও।
বৃহস্পতিবার ওড়িশা ম্যাচের দল নির্বাচনী বৈঠক ছিল। বৈঠকের আগে এ দিন সকালে তড়িঘড়ি লক্ষ্মীর ফিটনেস পরীক্ষার আয়োজনও করে সিএবি। কিন্তু বৈঠক শেষ হওয়ার পর দেখা যায়, ওড়িশা ম্যাচের যে টিম করা হয়েছে তাতে কোথাও প্রাক্তন বঙ্গ অধিনায়কের নাম নেই। প্রথমে মিডিয়ামহলে ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে, কর্নাটকের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে হাঁটুতে যে চোট পেয়েছিলেন লক্ষ্মী, তা নির্ঘাৎ সারেনি। তিনি নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ ফিট নন। কিন্তু রাত আটটা নাগাদ সিএবি থেকে প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বেরনোর সময় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ফিটনেসের জন্য নয়, লক্ষ্মীকে বাদই দেওয়া হয়েছে। টিমে তাঁর জায়গা হয়নি। এবং মিডিয়া-সৌরভ কথোপকথন দাঁড়াল এ রকম:
লক্ষ্মীর ফিটনেসের অবস্থা কী? কেন নেই?
‘‘নট সিলেক্টেড।’’
সেটা কি ফিটনেসের কারণে?
‘‘নট সিলেক্টেড।’’ (একটু সময় নিয়ে)
লক্ষ্মী কি ফিট? নাকি ফিট নন? (ক্লাবহাউসের এক তলায়)
‘‘ফিট। কিন্তু কাকে বাদ দেব? ও ম্যাচ ফিট হোক। পরের ম্যাচেই ফিরবে।’’
কিন্তু ওড়িশার পরের ম্যাচ তো অসমের সঙ্গে? লক্ষ্মী ম্যাচ পাবেন কী ভাবে?
‘‘আমরা তো নকআউটেও যেতে পারি। ও আগে এনএন ঘোষ ট্রফির কয়েকটা ম্যাচ খেলুক। নিশ্চয়ই ফিরবে।’’
শোনা গেল, এ ভাবে লক্ষ্মীকে ছেঁটে ফেলার কারণ মনোজ তিওয়ারি নেতৃত্বাধীন টিম ম্যানেজমেন্টের তাঁকে নিয়ে অনাগ্রহ। এঁরা চান না, টিমে বর্তমান যে স্পিরিট আছে তা লক্ষ্মীর প্রত্যাবর্তনে নষ্ট হোক। বলা হল, লক্ষ্মীর আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। লক্ষ্মী ও মনোজ একসঙ্গে থাকলে টিম বিভক্ত হয়ে যায়। গত বার যে কারণে ভুগতে হয়েছে বাংলাকে। বর্তমান টিম ম্যানেজমেন্ট নাকি মনে করছে, রঞ্জিতে যখন ভাল অবস্থায় আছে বাংলা, এই মুহূর্তে সেটাকে আর ঘাঁটানোর দরকার নেই। সৌরভ নিজেও নাকি যে কারণে এই মুহূর্তে লক্ষ্মীকে ফেরাতে খুব একটা ইচ্ছুক ছিলেন না। বৈঠকেও এ দিন লক্ষ্মী-প্রসঙ্গ সে ভাবে ওঠেনি। বর্তমান বাংলা অধিনায়ক নাকি বৈঠকে একজন বাড়তি স্পিনার চেয়েছেন ওড়িশা ম্যাচে। কিন্তু লক্ষ্মীকে নিয়ে কোনও কথা বলেননি। কোচ সাইরাজ বাহুতুলে মুম্বই থেকে টিম নিয়ে যে যা মতামত পেশ করেছিলেন সেখানেও নাকি লক্ষ্মীর নাম ছিল না। যা দেখেশুনে ময়দানের কেউ কেউ বলছেন, দেওয়াল লিখনটা পড়াই যাচ্ছিল। এটা ঠিক যে লক্ষ্মীরতন শুক্লর পরিবর্ত আজও হয় না। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট একটা নির্দিষ্ট সেট-আপে চলতে চাইলে কী করা যাবে? খারাপ খেললেও কথা ছিল।
আর একটা অংশের যে যুক্তি শুনে হাস্যকর মনে হচ্ছে। ইস্তফা দিয়ে চলে যাওয়া বাংলার প্রাক্তন নির্বাচক প্রধান রাজু মুখোপাধ্যায় যেমন। সিএবি-সিদ্ধান্তের কথা শুনে যিনি চাঁচাছোলা ভাবে শুনিয়ে রাখলেন, ‘‘আমি শক্ড। ও শুধু অসাধারণ ক্রিকেটার নয়, অসাধারণ ক্যাপ্টেনও। তাকে এ ভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া হল?’’ সঙ্গে রাজুর উষ্মা, ‘‘বাংলা ক্রিকেটের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, লক্ষ্মী যতগুলো ম্যাচ বাংলাকে বাঁচিয়েছে বা জিতিয়েছে, তার ধারেকাছে কেউ নেই।’’ এই অংশ মনে করে, লক্ষ্মীর সঙ্গে চরম অন্যায় হল। সিএবি ভুলে গেল, এই একই লোক বছর দু’য়েক আগে বাংলাকে একা হাতে রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনালে তুলেছিল। যখন টিমে ঋদ্ধিমান সাহা, মনোজ তিওয়ারি কেউ ছিলেন না। সিএবি ভুলে গেল, এই একই লোক বাংলাকে একমাত্র বিজয় হাজারে ট্রফি দিয়েছিল। মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ফাইনালে সেঞ্চুরি করে, চার উইকেট নিয়ে।
গত মরসুম খুব ভাল যায়নি লক্ষ্মীর। ৩৩৭ রান করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার আগের বছর ৬০৮ রান আছে। বাংলা ওই বছর বারবার ৫০-৫ হয়েছে, আর তিনি এসে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে বাঁচিয়েছেন, এমনকী জিতিয়েওছেন বাংলাকে। এঁরা প্রশ্ন তুলছেন, লক্ষ্মীর মতো ক্রিকেটারকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, সেটা বৈঠক থেকে তাঁকে জানানো হয়েছে কি? এঁরা অভিযোগ করছেন, নির্বাচনী বৈঠকটা এখন নামেই হয়। অলিখিত নির্বাচক প্রধান সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামেই নির্বাচক প্রধান। তাঁর হাতে সে ভাবে কোনও ক্ষমতাই নেই। বাংলা ক্রিকেটের নীতি ঠিক করেন দু’জন। সৌরভ এবং মনোজ।
রাতের দিকে কেউ কেউ বললেন, এ দিন বাদ পড়লেন বলে যে লক্ষ্মীর রঞ্জি কেরিয়ার শেষ হয়ে গেল এমন নয়। বরং তাঁর ফেরার সম্ভাবনা আছে। বাংলা রঞ্জি নকআউটে গেলে সে সব আছে। রঞ্জি একদিনের ম্যাচের টিমেও তিনি নাকি নিশ্চিত ঢুকবেন। ঘটনা হল, সৌরভের কথা ধরলে লক্ষ্মীকে এএন ঘোষ খেলে ফিরতে হবে। যা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হওয়ার কথা থাকলেও মাঠ সমস্যা থাকায় কবে হবে নিশ্চিত নয়। ও দিকে বিজয় হাজারে শুরু হচ্ছে ১০ ডিসেম্বর থেকে। লক্ষ্মী ম্যাচ প্র্যাকটিস তা হলে পাবেন তো? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক তত দিন পর্যন্ত নিজের কেরিয়ার টানবেন কি না। সিএবির সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি লক্ষ্মী। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠমহল দাবি করল যে, খবর শোনার পর ক্রিকেটকিট নাকি বন্ধ করে দেন প্রাক্তন অধিনায়ক। এতটাই ভেঙে পড়েন যে ঘনিষ্ঠদের বলে দেন, আর নয়। বাংলার হয়ে আর নামবেন না। বাংলা ছেড়ে অন্য কোনও রাজ্যে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ক্রিকেটটাই তাই ছেড়ে দেবেন।
ভারত অধিনায়ক থাকাকালীন অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পদে বৃহস্পতিবার যে সিদ্ধান্তটা নিলেন, সেটাও নিঃসন্দেহে কঠোর। দ্রষ্টব্য হল, বাংলা ক্রিকেট এখন কী ভাবে এর মোকাবিলা করে। কারণ এ দিনের পর শুধু ওড়িশা বা অসম নয়, মনোজ তিওয়ারির টিমকে আরও একটা প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলতে হবে। আবেগ-প্রতিপক্ষ।
বাংলা বনাম লক্ষ্মীরতন শুক্ল!
No comments:
Post a Comment