Wednesday, November 18, 2015

খেল খতম আবাউদের? সাত ঘণ্টার যুদ্ধ শেষেও ধোঁয়াশা

শুক্রবার রাত নেমেছিল বারুদগন্ধ আর মৃত্যুমিছিলের আতঙ্কে। ঠিক চার দিন পর কাকভোরে গুলির-বোমার কানফাটানো আওয়াজে আরও এক বার কেঁপে উঠল প্যারিস। তবে এ বার আর জঙ্গি হানা নয়। যুদ্ধটা জঙ্গিদের ঘরে পৌঁছে দিল ফরাসি পুলিশ ও সেনার বিশেষ দল। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, প্যারিসে জঙ্গি হানার মূল চক্রীর গোপন আস্তানায়। বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে পাওয়া খবর বলছে, প্যারিসের উত্তর শহরতলি স্যাঁ দেনি-তে আজ নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সাত ঘণ্টার যুদ্ধে নিহত হয়েছে ১৩/১১-র পাণ্ডা আবদেলহামিদ আবাউদ। কিন্তু সরকারি ভাবে সেই খবরের সত্যতা এখনও স্বীকার করেনি ফ্রান্স সরকার।
ধুন্ধুমার গুলিযুদ্ধে ঠিক কত জন জঙ্গি মারা গিয়েছে, ধোঁয়াশা কাটছে না তা নিয়েও। অবশ্য একটি মৃত্যু নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সে হল, সোনালি চুলের এক মহিলা। সেনা-পুলিশ-সোয়াট টিমের মুখোমুখি হয়ে যে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছে। কে এই মহিলা? সঠিক উত্তর নেই। কেউ কেউ বলছেন, সম্ভবত আবাউদের স্ত্রী। কেউ বলছেন, না-ও হতে পারে!
কিন্তু আবাউদ কোথায়? সব চেয়ে বড় প্রশ্ন এখন সেটাই। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, স্যাঁ দেনি-র ওই অ্যাপার্টমেন্টে ঘাঁটি গেড়েছিল আট জঙ্গি। তাদের মধ্যে ওই মহিলা জঙ্গিটি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়। আর এক জনকে ছাদ থেকে গুলি করে মারে পুলিশের বন্দুকবাজ। ধরা পড়ে বাকি ছ’জন। আবার অন্য একটি সূত্রের দাবি, একমাত্র ওই মহিলাই মারা গিয়েছেন। ধরা পড়েছে ৭ জন। এখন প্রথম ব্যাখ্যাটিই যদি সত্যি হয়, তা হলে সেই নিহত জঙ্গি আবাউদ কি না, তারও কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই। এমনকী ওই জঙ্গি আবাউদের ভাই— এমন ব্যাখ্যাও দিয়েছে কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম।  ভারতে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত ফ্রাঁসোয়া রিশিয়ে আবার বলেছেন সম্পূর্ণ অন্য সম্ভাবনার কথা। তাঁর কথায়, ‘‘যত দূর খবর পেয়েছি আবাউদ প্যারিসের শহরতলির অ্যাপার্টমেন্টে থাকত। পুলিশ সেখানে হানা দিলে সে আত্মহত্যা করে। প্রাথমিক তথ্যে তা-ই মনে হচ্ছে। কিন্তু তাকে মৃত ঘোষণা করার মতো প্রমাণ এখনও মেলেনি।’’
যে এলাকায় আজ ‘যুদ্ধ’ চলে, তার খুব কাছেই স্তাঁদ দো ফ্রঁস। ১৩/১১-র রাতে জঙ্গিদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল এই স্টেডিয়াম। বিশেষ সূত্রে পুলিশের কাছে খবর ছিল, সিরিয়া থেকে ফিরে স্যাঁ দেনি-র ওই আবাসনে সাত সঙ্গীকে নিয়ে ডেরা বেঁধেছে আবাউদ। ভোরের আলো ফোটার আগেই তিন ট্রাক ভর্তি সশস্ত্র বাহিনী ঘিরে ফেলে অ্যাপার্টমেন্টটিকে। আশপাশের বাড়িগুলির ছাদে ‘পজিশন’ নেয় স্নাইপার (বন্দুকবাজ) বাহিনী। লাগোয়া সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুরু হয় ‘অপারেশন’। পুলিশের দাবি, সংঘর্ষ শুরুর কিছু পরেই ওই আবাসন থেকে বেরিয়ে আসে সোনালি চুলের মহিলাটি। বাইরে মোতায়েন পুলিশ তাকে ধরার আগেই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় সে। আরও কয়েক ঘণ্টা গুলিযুদ্ধের পরে কাবু করা হয় বাকিদেরও।
জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে ওই বাড়ির মালিককেও। বছর তিরিশের ওই ব্যক্তির দাবি, ‘‘এক বন্ধু অনুরোধ করেছিল, বেলজিয়াম থেকে আসা কয়েক জনের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। আমি বলেছিলাম ওখানে খাট-বিছানা নেই। ওরা বলেছিল, শুধু একটু জল আর প্রার্থনা করার জায়গা পেলেই চলবে। কিন্তু ওরা যে জঙ্গি তা একেবারেই বুঝতে পারিনি।’’
শুক্রবার রাতের জঙ্গিদের খোঁজে চলছে জোরদার তল্লাশি। বুধবার
প্যারিসের কাছে স্যাঁ দেনি এলাকায় অভিযানে ব্যস্ত এক পুলিশকর্মী। ছবি: রয়টার্স।
বুঝতে পারেননি ওই আবাসনের অন্য বাসিন্দারাও। বুধবার ভোরে যখন গোলাগুলির আওয়াজে তাঁদের ঘুম ভাঙে, তখন ভেবেছিলেন ফের জঙ্গি হামলা হয়েছে বুঝি। ওই আবাসনেরই বাসিন্দা এক মহিলার কথায়, ‘‘অত ভোরে গোলাগুলির শব্দে একরত্তি ছেলেটা কাঁদতে শুরু করেছিল। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল। আমার বাড়ির ঠিক ওপরের তলাতেই চলছিল সংঘর্ষ। কেঁপে কেঁপে উঠছিল দেওয়াল। আর ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছিল।’’ প্রায় একই অভিজ্ঞতা স্থানীয় বাসিন্দা সানোকো আবদুলাইয়ের। বললেন, ‘‘জানলা দিয়ে দেখছিলাম সশস্ত্র পুলিশ ওই আবাসনের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে। আকাশে হেলিকপ্টার। ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে চার দিক। হঠাৎ দেখলাম সোনালি চুলের এক মহিলাকে। নিজেই নিজেকে উড়িয়ে দিল সে।’’ আজ জঙ্গিদের গুলিতে মারা গিয়েছে একটি স্নিফার ডগ। আহত হয়েছেন পাঁচ পুলিশকর্মী। ধৃতদের জেরা করে জানার চেষ্টা চলছে, কেন ওই আবাসনে ঘাঁটি গেড়েছিল তারা? নিছক গা ঢাকা দিতে? নাকি নতুন কোনও হামলার ছক কষছিল তারা?
নিশ্চিত খবর আসার আগে অবধি আবাউদকে নিয়ে চিন্তা থাকছেই। কারণ, তার মৃত্যুর ভুয়ো খবর ছড়িয়েছে এর আগেও। গত বছর সিরিয়া থেকে আবাউদের পরিবারকে জানানো হয়— ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে ‘শহিদ’ হয়েছে সে। আবাউদের দিদি ইয়াসমিনা আজ বলেছেন, ‘‘প্রার্থনা করি এ বার যেন ও সত্যিই মরেযায়।’’ বাবা ওমর স্থানীয় এক সাংবাদিককে বলেছেন, ‘‘পরিবারটাকে ও ছারখার করে দিল। আর ওর মুখ দেখতে চাই না!’’ 

No comments:

Post a Comment