নভেম্বর ১৯১৫। এক মাস জুড়ে পর পর ২৪টি লেকচার। বদলে গেল মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণা। সেই লেকচারগুলি নিয়ে সে বছরেরই ২ ডিসেম্বর প্রকাশিত হল পেপার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে প্রথমে নজরে না পড়লেও অচিরেই পদার্থবিদ্যা মহলে ঝড় উঠল। কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা নিউটনীয় বিশ্বভাবনা আমূল পাল্টে গেল। আর এক সপ্তাহ পরেই আলবার্ট আইনস্টানের সেই সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শতবর্ষ। ধূপ, গান, ফুলের মালা, লম্বা স্মৃতিচারণের আবেগমাখা আনুষ্ঠানিকতায় বিজ্ঞানীরা বিশেষ বিশ্বাস করেন না। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শতবর্য পালনে তাই ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’ মহাকাশে পাঠাচ্ছে এক যান। নাম ‘লিসা পাথফাইন্ডার’। কাজ এই আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একটি অনুমানকে পরীক্ষা করা।
আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বলে দেশ-কালের জ্যামিতির জালে আটকে রয়েছে এই মহাবিশ্ব। সেই তত্ত্বেই আছে ‘মহাকর্ষীয় তরঙ্গ’-এর কথা। কেমন করে তৈরি হয় এই তরঙ্গ? তত্ত্ব বলেছে, যখন কোন নক্ষত্রের ভরের পরিবর্তন ঘটে তখন এই তরঙ্গ তৈরি হবে। যেমন, কোনও নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার সময়ে, বা দু’টি নিউট্রন নক্ষত্র ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ পরস্পরের কাছে আসার সময়ে (বাইনারি সিস্টেম) দেশ-কালের জালে কখনও তীব্র ঠেলা লাগে, কখনও তীব্র টান। ওঠে দোলা। এই দোলাই তরঙ্গের আকারে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
শুধু খাতা-কলমে থাকলে হবে না, বি়জ্ঞানের তত্ত্বকে প্রমাণের পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। আপেক্ষিকতাকেও হয়েছিল। প্রথম পরীক্ষা হয় ১৯১৯-এ। করলেন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময়ে কয়েকটি নক্ষত্র থেকে আসা আলোর গতিপথে নজর রেখে দেখলেন তা বেঁকে যাচ্ছে। আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সূর্যের প্রভাবে এমনটাই হওয়া কথা।
কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আছে কি না তার জন্য অপেক্ষা করতে হল ১৯৭৪ পর্যন্ত। একটু ঘুরপথে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের কথা জানালেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ জোসেফ টেলর এবং রাসেল হল্স। তাঁরা দেখলেন একটি নিউট্রন নক্ষত্রের (যা কি না একটি অন্য একটি নিউট্রন নক্ষত্রের সঙ্গী) কক্ষপথ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এই হ্রাসের হার মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ছড়িয়ে দেওয়ার হারের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ১৯৯৩-এ এই কাজের জন্য যুগ্মভাবে নোবেল পেলেন টেলর ও হল্স।
কিন্তু মহাকর্ষীর তরঙ্গের সরাসরি প্রমাণ এখনও মেলেনি। সরাসরি প্রমাণের জন্য বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করেছেন। যেমন, দু’টি বেশ লম্বা ধাতব হাতলকে পরস্পরে সমকোণে রেখে দেওয়া হয়েছে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধাক্কায় একটি হাত অল্প সঙ্কুচিত আর অন্য হাতটির প্রসারিত হওয়ার কথা। কিন্তু এ পরিবর্তিন এতই এতই সূক্ষ্ম যে তা মাপা খুব কঠিন। অতিসংবেদনশীল যন্ত্র বসিয়েও কিছু মেলেনি। তাই এবার বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খুঁজতে মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়ার। যেখানে প্রায় ৫০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে বসানো দু’টি সন্ধানী যন্ত্র মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রভাবে দেশ-কালের সূক্ষ্ম সংকোচন-প্রসারণ ধরতে পারবে। আর এই পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে ‘লিসা পাথফাইন্ডার’।
লিসার ভিতরে মহাশূন্যে ভাসমান অবস্থায় সোনা আর প্ল্যাটিনামের দু’টি কিউব রয়েছে। এমন করে আগলে কিউব দু’টিকে রাখা হয়েছে যে তেজস্ক্রিয়তা বা মহাজাগতিক কণার কোনও প্রভাব তাদের উপরে পড়বে না। লিসায় লেজারের সাহায্যে এই দু’টি কিউবের অবস্থানের সূক্ষ্ম পার্থক্য মাপা হবে। দেখা হবে মাপার এই পদ্ধতি ঠিকঠাক কাজ করছে কি না। যদি করে তবে ধাপে ধাপে ধাপে মহাকাশেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ মাপার পর্যবেক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। যা জ্যোতির্বিদদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। তবে তার জন্য অবশ্য আরও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে, পেরোতে হবে বেশ কিছু প্রযুক্তিগত বাধাও। এমনই জানিয়েছে ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’। তার আগে ২ ডিসেম্বর ‘লিসা পাথফাইন্ডার’-উৎক্ষেপণের মাধ্যমেই আপেক্ষিকতার শতবর্ষ উদ্যাপনের অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ব।
No comments:
Post a Comment