বেগুন খেতে ফুল ধরেছে। তার উপরে গুনগুন করছে মৌমাছির ঝাঁক।
দেখে চাষিও নিশ্চিন্ত। এ বার ওরা ফুলে-ফুলে উড়ে বেড়িয়ে মধু খাবে। সঙ্গে খুলে দেবে ভাল ফলনের রাস্তা।
কিন্তু এ কী হল?
ফুল থেকে সোজা যে ফের বাক্সেই এসে ঢুকল মৌমাছিগুলো! আর ঢুকে সেই যে নেতিয়ে পড়ল, ওঠার নাম নেই! সব শক্তি শুষে কেউ যেন ওদের ছিবড়ে করে ছেড়ে দিয়েছে!
বেগুনের পরাগমিলন ঘটাতে গিয়ে অগত্যা মাথায় হাত বসিরহাটের চাষি রমেন রায়ের। মাঠে ক’হাত দূরে দূরে রাখা বড় বড় বাক্স। মৌমাছিদের আস্তানা। যা শুধু রমেনবাবুর নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিরাট সংখ্যক কৃষকের মস্ত ভরসা। কুমড়ো, শসা, তরমুজ থেকে শুরু করে মরসুমি সবজি— চাষের জমিতে এই সব বড় বাক্সে মৌমাছি নিয়ে গিয়ে পরাগসংযোগ ঘটানো হয়। মৌমাছি-মাধ্যমে পরাগসংযোগের উপরে বহুলাংশে নির্ভর করে ফলনের পরিমাণ।
বেগুন ফলাতে রমেনবাবুও এত দিন মৌমাছির উপরে ভরসা করে এসেছেন। ইদানীং ভরসা টুটেছে। দেখছেন, মৌমাছিরা বেগুন-ফুলে বসেই কেমন নেতিয়ে পড়ছে। পরে আর সেই গাছ-মুখোই হচ্ছে না!
এমতাবস্থায় রমেন রায়ের মতো রাজ্যের বহু কৃষকই দিশেহারা। মৌমাছিদের হঠাৎ হলটা কী?
বিশেষজ্ঞদের একাংশ আঙুল তুলছেন কীটনাশকের দিকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সেন্টার ফর পলিনেশন স্টাডিজ-এর সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিভিন্ন পোকার হাত থেকে ফসল বাঁচাতে চাষের খেতে যে ভাবে ঢালাও কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে, তাতে মৌমাছির মতো ‘বন্ধু’ পতঙ্গও কাবু হয়ে পড়ছে। তাদের ঘ্রাণশক্তি কমছে, ওড়ার ক্ষমতায় টান ধরছে। অনেক মৌমাছি মরেও যাচ্ছে।
পরিণামে যে সব ফসলে বাহকনির্ভর পরাগমিলন জরুরি, তার ফলন মার খাচ্ছে। ‘‘কীটনাশকের প্রভাবে মৌমাছি-সহ অন্যান্য পরাগসংযোগকারী পতঙ্গের সংখ্যা কমছে। সমীক্ষায় দেখছি, দুই চব্বিশ পরগনায় কীটনাশকের সংস্পর্শে অনেক ক্ষেত্রে মৌমাছিরাও মারা যাচ্ছে।’’— বলছেন সেন্টারের অধিকর্তা অধ্যাপক পার্থিব বসু। তাঁর পর্যবেক্ষণ, নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল উৎপাদনের জন্য যতটা পরাগসংযোগ দরকার, মৌমাছির সংখ্যা কমে যাওয়ায় ততটা হচ্ছে না। ফলনে ব্যাঘাত ঘটছে।
সেন্টার-সূত্রে জানা যাচ্ছে, কুমড়ো, লাউ, শসা, বেগুন, আপেল, কমলালেবুর মতো উদ্ভিদের ক্ষেত্রে পুরুষ-ফুলের পরাগ স্ত্রী-ফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়ে পরাগমিলন ঘটে। বীজ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর এ ক্ষেত্রে পরাগমিলন ঘটায় মৌমাছি। কৃষি-কর্তারা জানিয়েছেন, পরাগমিলনের দরুণ বীজের সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়ে। ফল ধরার হার বৃদ্ধি পায়। ফল ঝরা বন্ধ হয়। রোগ ও পোকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তিও বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, মৌমাছির মাধ্যমে নিষেকের ফলে গড় ফলন সাধারণত ১৫%-২০% বেড়ে যায়।
কিন্তু কীটনাশকের সৌজন্যে এখানেই সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়েছে। সেন্টারের গবেষণা-রিপোর্ট অনুযায়ী, মূলত অর্গানোফসফরাস (ডাইমিথোইট), সাইপারমেট্রিন ও অর্গানোক্লোরিন (এন্ডোসালফান) জাতীয় কীটনাশকের ব্যবহারে এপিস সেরেনা ইন্ডিকা প্রজাতির ভারতীয় মৌমাছি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মৌমাছিপালক সমবায় সমিতির ডিরেক্টর প্রণবকুমার রাজের আক্ষেপ, ‘‘কীটনাশকের তেজে মৌমাছিগুলো অকালে মরছে। বংশবিস্তার করতে পারছে না। কৃষি দফতরকে বারবার বলেছি, চাষে পেস্টিসাইড কমানো হোক। কিছুই হয়নি।’’ দুই চব্বিশ পরগনায় প্রচুর মানুষ মৌমাছি পালন করেন, যাদের সংসার চলে মধু বেচে। তারাও সঙ্কটে। ‘‘দশ বছর আগে দু’জেলায় মৌমাছিপালক ছিলেন হাজার দেড়েক। এখন মেরে-কেটে পাঁচশোও হবে না!’’— মন্তব্য প্রণববাবুর।
সুরাহা কী? একমাত্র জৈবপদ্ধতির চাষে পরিত্রাণ মিলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষ়জ্ঞেরা। উদাহরণ দিতে গিয়ে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক ব্রহ্মচারী বলেন, ‘‘নিমগাছ থেকে তৈরি ভেষজ বিষ এখন বাজারে এসেছে। তাতে শত্রু-পোকা ধ্বংস হলেও মৌমাছির মতো বন্ধু-পতঙ্গের ক্ষতি হবে না।’’ কৌশিকবাবুর দাবি, জীবাণুঘটিত কৃষিবিষ ব্যাকটেরিয়াম (ব্যাসিলাস থুরিনজিয়ানসিস)-ও কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। ‘‘এতে লেদাপোকা-শুঁয়োপোকার অত্যাচার কমবে। অথচ মৌমাছি রক্ষা পাবে।’’— বলছেন তিনি। রাজ্য কৃষি দফতরের মুখ্য পতঙ্গবিদ বিজয় চৌধুরীরও অভিমত, জীবাণুঘটিত কীটনাশকের (বিউভেরিয়া, পলিহাইড্রাল ভাইরাস) ব্যবহারে বন্ধু-পোকা সুরক্ষিত থাকবে।
সরকার কী ভাবছে?
আধিকারিকদের দাবি, সঙ্কট সম্পর্কে প্রশাসন সম্যক ওয়াকিবহাল। সমাধানের চেষ্টা চলছে। কৃষি দফতরের অতিরিক্ত অধিকর্তা (গবেষণা) সম্পদরঞ্জন মহাপাত্রের মন্তব্য, ‘‘ক্ষতিকারক কীটনাশকের প্রভাবে মৌমাছি ছাড়াও বেশ কিছু পতঙ্গের প্রাণহানি ঘটছে। পরিবেশে ভারসাম্য থাকছে না।’’ এ ব্যাপারে সরকারি তরফে কৃষকদের নানা ভাবে সচেতন করা হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন। বিজয়বাবু বলেন, ‘‘কীটনাশকের অপকারিতার দিকটা মাথায় রেখে দেখা হচ্ছে, কী ভাবে জৈব পদ্ধতিতে রোগ-পোকার হামলা রোখা যায়।’’
No comments:
Post a Comment