হাসপাতাল থেকে বের করা হচ্ছে প্রয়াত ডালমিয়াকে। রয়েছেন সৌরভ। রবিবার।
চোখ দু’টো বন্ধ। গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে শরীরটা এখন ঢেকে দেওয়া হয়েছে। স্ট্রেচার এল, দুঁদে ক্রিকেট-প্রশাসককে ওখানে তুলতে হবে। গাড়িতে পাঁচ মিনিট দূরত্বের দশ নম্বর আলিপুর রোডের বাড়িতে এখন যাবেন তিনি। থাকবেন আজকের রাত। কাল সকালে একবার সিএবি। বোর্ড কর্তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য, আপামর বঙ্গ ক্রিকেটপ্রেমীদের শেষ বারের মতো ভালবাসার তর্পণ মিটলে ওখান থেকে তার পর কালীঘাট মহাশশ্মান।
তিনি তো আর নেই। জগমোহন ডালমিয়া আর নেই। শহরের বুকে নিষ্প্রাণ শরীরটা আছে আর একটা দিন।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে মনে হচ্ছে, কেউ তাঁকে কোনও অজানা জাদুমন্ত্রে প্রস্তরমূর্তি করে দিয়েছে। জাতীয় মিডিয়া চ্যানেলের ওবি ভ্যানগুলো ছুটল দেখে। কথা বলতে পারলেন না সৌরভ। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক দীপ দাশগুপ্তকে দেখা গেল। চোখটা লাল। সিএবি কর্তাদের কেউ কেউ অঝোরে কাঁদতে-কাঁদতে বিলাপ করছেন। কেউ প্রচণ্ড মানসিক ‘শক’-এ সাময়িক মূক ও বধির। জবুথবু হয়ে বসে।
মাথার উপর এত দিনের বনস্পতি তো আর নেই। জগমোহন ডালমিয়া আর নেই।
রবিবার রাত পৌনে ন’টায় আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভারতীয় ক্রিকেটের এক স্বর্ণ-অধ্যায় শেষ হয়ে গেল। মৃত্যুর সঙ্গে তিন দিন যুদ্ধ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন জগমোহন ডালমিয়া। চলে গেলেন পঁচাত্তর বছর বয়সে। বঙ্গ ক্রিকেটকে অনাথ করে। ভারতীয় ক্রিকেটকে বিহ্বল করে।
এবং প্রশ্ন তুলে দিয়ে।
গত বাহাত্তর ঘণ্টা ধরে বারবার হাসপাতালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডালমিয়া স্থিতিশীল। তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। গত চব্বিশ ঘণ্টাতে সরকারি বিবৃতিতে ন্যূনতম বিপর্যয়ের আন্দাজ দেওয়া হয়নি। এ দিন সকালেও বোঝা যায়নি কিছু। বরং পরিবারের কেউ কেউ আশাবাদে ভুগেছেন যে, আর দিন তিনেক পর বাড়ি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। শোনা গেল, এ দিন সকাল থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির শুরু। দ্রুতই মেডিক্যাল বোর্ড বসে যায় চিকিৎসক
অনিল মিশ্রর নেতৃত্বে। দুপুরের দিকে ডালমিয়ার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়। দু’টো স্টেন্টও বসে। রাতের দিকে অনিল মিশ্র সাংবাদিক সম্মেলনে বলেও গেলেন যে, ‘‘গণ্ডগোলটা হল রাতের দিকে। স্টেন্ট বসানোর সময় শারীরিক অবস্থা ঠিকই ছিল। আচমকাই রাতে ওঁর পাকস্থলী থেকে প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সব রকম চেষ্টা করেও আমরা কিছু করতে পারিনি।’’ যে ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে ডালমিয়া-পরিবারই। ডালমিয়া-কন্যা বৈশালী ডালমিয়া গভীর রাতে সোজাসুজি বললেন, ‘‘সন্ধে অবধি বাবা ভাল আছেন, আমাদের বলা হল। কিন্তু সাড়ে আটটা নাগাদ যে কী হল, আমরা এখনও বুঝতে পারছি না। আমাদের সামনেই ওঁরা হঠাৎই দরজাগুলো বন্ধ করতে শুরু করে দেন। বলেন অবস্থা খারাপ হয়েছে। মা কাঁপছিলেন। বাবাকে জল পর্যন্ত খাওয়াতে দেয়নি ওঁরা। দশ মিনিটের মধ্যেও জানিয়ে দেওয়া হয় যে বাবা আর নেই।’’ এখানেই না থেমে বৈশালী আরও যোগ করেন, ‘‘পাকস্থলীতে রক্তক্ষরণের কথা যে বলা হচ্ছে সেটা কেন বুঝতে পারছি না। বাবার কিন্তু কোনও আলসার বা অন্য কোনও সমস্যা ছিল না।’’ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনিও বেশ কিছু ধোঁয়াশা রেখে চলে গেলেন। এক, ভর্তির দিন বারবার জিজ্ঞেস করা হলেও হাসপাতাল থেকে বলা হয়নি যে, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হয়েছে। আজ কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হল, সেটা হয়েছে। অর্থাৎ-- দু’টো বক্তব্যে মিল নেই। আর দুই, কেন পাকস্থলীতে রক্তক্ষরণ হল তা নিয়েও কোনও পরিষ্কার উত্তর পাওয়া গেল না। অনিল মিশ্রর বক্তব্য, ‘‘অনেক সময় এ রকম হয়।’’ যা শুনে বৈশালী বললেন, ‘‘আমরা এ সব নিয়ে বিরক্ত।’’ অতএব, প্রশ্ন।
অনিল মিশ্রর নেতৃত্বে। দুপুরের দিকে ডালমিয়ার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়। দু’টো স্টেন্টও বসে। রাতের দিকে অনিল মিশ্র সাংবাদিক সম্মেলনে বলেও গেলেন যে, ‘‘গণ্ডগোলটা হল রাতের দিকে। স্টেন্ট বসানোর সময় শারীরিক অবস্থা ঠিকই ছিল। আচমকাই রাতে ওঁর পাকস্থলী থেকে প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হয়। সব রকম চেষ্টা করেও আমরা কিছু করতে পারিনি।’’ যে ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে ডালমিয়া-পরিবারই। ডালমিয়া-কন্যা বৈশালী ডালমিয়া গভীর রাতে সোজাসুজি বললেন, ‘‘সন্ধে অবধি বাবা ভাল আছেন, আমাদের বলা হল। কিন্তু সাড়ে আটটা নাগাদ যে কী হল, আমরা এখনও বুঝতে পারছি না। আমাদের সামনেই ওঁরা হঠাৎই দরজাগুলো বন্ধ করতে শুরু করে দেন। বলেন অবস্থা খারাপ হয়েছে। মা কাঁপছিলেন। বাবাকে জল পর্যন্ত খাওয়াতে দেয়নি ওঁরা। দশ মিনিটের মধ্যেও জানিয়ে দেওয়া হয় যে বাবা আর নেই।’’ এখানেই না থেমে বৈশালী আরও যোগ করেন, ‘‘পাকস্থলীতে রক্তক্ষরণের কথা যে বলা হচ্ছে সেটা কেন বুঝতে পারছি না। বাবার কিন্তু কোনও আলসার বা অন্য কোনও সমস্যা ছিল না।’’ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনিও বেশ কিছু ধোঁয়াশা রেখে চলে গেলেন। এক, ভর্তির দিন বারবার জিজ্ঞেস করা হলেও হাসপাতাল থেকে বলা হয়নি যে, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হয়েছে। আজ কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হল, সেটা হয়েছে। অর্থাৎ-- দু’টো বক্তব্যে মিল নেই। আর দুই, কেন পাকস্থলীতে রক্তক্ষরণ হল তা নিয়েও কোনও পরিষ্কার উত্তর পাওয়া গেল না। অনিল মিশ্রর বক্তব্য, ‘‘অনেক সময় এ রকম হয়।’’ যা শুনে বৈশালী বললেন, ‘‘আমরা এ সব নিয়ে বিরক্ত।’’ অতএব, প্রশ্ন।
প্রশ্ন একটা নয়, আরও আছে। বোর্ড— তার এ বার কী হবে? সিএবি— তার? বোর্ডে বয়স্কতম ভাইস প্রেসি়ডেন্ট এখন কাজ চালাবেন। সিএবির গঠনতনন্ত্র তুলে কেউ কেউ বললেন যে, দু’মাসের মধ্যে বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। তত দিন পর্যন্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট আর আধিকারিকরা চালাবেন। কিন্তু তার পরেও কি বিপদ-আপদে পাওয়া যাবে ‘জগুদা’-সম সমাধানের খোঁজ? সিএবি কর্তারা জানেন না। এতটাই বিপর্যস্ত যে কেউ এ নিয়ে কথাও বলতে চান না। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত হাসপাতালে এসে বলে গেলেন যে, আজ তাঁর গভীর দুঃখের এক দিন। বলে গেলেন, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে ডালমিয়ার অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হবে। ‘‘জগমোহন ডালমিয়া আদ্যন্ত ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ ছিলেন। উনি এমন একজন মানুষ যিনি জীবনের থেকেও ক্রিকেটকে বেশি ভালবাসতেন। সারা জীবন রাজমুকুট মাথায় ছিল। গেলেনও রাজমুকুট নিয়ে।’’
শোনা গেল, সোমবার সকালেই এক ঝাঁক বোর্ড কর্তার সঙ্গে ঢুকে পড়ছেন ভারতীয় টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী। শশাঙ্ক মনোহর, শরদ পওয়ার, অনুরাগ ঠাকুর, রাজীব শুক্ল থেকে শুরু করে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন— কেউ বাদ যাচ্ছেন না। কেউ যাবেন বাড়িতে, কেউ সিএবিতে। যেখানে দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত প্রয়াত ডালমিয়াকে রাখা হবে। বিরাট কোহলি— তিনিও নাকি আসতে পারেন। যোগাযোগের চেষ্টা চলছে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সঙ্গে। আসন্ন ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের আগের যাবতীয় কাজকর্ম বাতিল করে দেওয়া হল এ দিন রাতেই। আর ইডেনে ৮ অক্টোবরের ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি? ওখানেও ধন্দ। সিএবির একাংশ চাইছে, এ অবস্থায় মানে হয় না। আর একদল বলছে, ওটা হবে। কারণ জগমোহন ডালমিয়া ম্যাচটা হাতে করে এনেছিলেন। বরং সেটাই হবে তাঁর প্রতি আসল সম্মান-প্রদর্শন। আইএফএ ঘোষণা করে দিয়েছে, সোমবার সমস্ত ডিভিশনের ম্যাচ বন্ধ। আইএফএ প্রেসিডেন্ট সুব্রত দত্ত যা বলে গেলেন।
স্বাভাবিক। শুধু ক্রিকেট নয়, গোটা বাংলা ক্রীড়াপ্রশাসনের গর্বের নক্ষত্র ছিলেন ডালমিয়া। যিনি বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে দেশ, দেশ ছাড়িয়ে ক্রিকেটবিশ্ব— বিচরণ করেছেন সমস্ত জায়গায়। তাঁর প্রয়াণে সমস্ত খেলাধুলো যে কাঁদবে, স্বাভাবিক। অশ্রুসজল আবেগের দৃশ্য তৈরি হবে, তাতেও আশ্চর্যের কিছু নেই। শ্যামবাজার থেকে ভবানীপুর— সমগ্র কলকাতার ক্রীড়াপ্রেমীরা আজ শোকস্তব্ধ। ভবানীপুরের দত্ত বাড়ির ৯০ বছরের বৃদ্ধ যেমন। সন্ধেবেলায় টিভি চালিয়ে দেখেন, জগমোহন ডালমিয়া আর নেই। ছেলেকে ডেকে খবরটা দেন। তার পর বসে পড়েন মাথা চেপে। টিভি বন্ধ করে দেন। ঘর করে দেন অন্ধকার।
ইনি— বিশ্বনাথ দত্ত। ময়দান যাঁকে জানে, প্রশাসনে জগমোহন ডালমিয়ার ‘গুরু’ বলে।
গুরু আজকের পর থাকবেন। শুধু শিষ্য থাকবেন না।
No comments:
Post a Comment