জায়ান্ট স্ক্রিন জুড়ে একটা বাঘ। তার গায়ে সাদা ডোরাগুলোয় ফুটে উঠছে ছ’টা ইংরেজি অক্ষর। কিংবদন্তি একটা নাম— গুগ্ল। আর পাঁচটা ‘গুগ্ল ডুডলের’ সঙ্গে এটার পার্থক্য একটাই। বাঘটার উপরে-নীচে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়ায় লেখা দু’টো শব্দ— ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’!
গুগ্লপ্লেক্স— গুগ্লের সদর দফতর। সেখানেই ওই জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি। হলদে শার্ট, কালো প্যান্ট আর হাতকাটা জ্যাকেটের নরেন্দ্র মোদীকে দেখে এক ঝলকে মনে হচ্ছিল— প্রধানমন্ত্রী নন, কোনও সিইও যেন বক্তব্য রাখছেন মাইক্রোফোনে। এক অর্থে কথাটা হয়তো ভুলও নয়। আমেরিকার সিলিকন ভ্যালিতে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সিইও-র ভূমিকাই যেন পালন করলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। গত কাল থেকে আজ— তাঁর সফরে আগামী ভারতের স্বপ্নের সঙ্গে পরতে পরতে জুড়ে গেল দুনিয়ার তথ্যপ্রযুক্তির ‘প্রাণকেন্দ্র’ বলে পরিচিত সিলিকন ভ্যালি।
কখনও ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র স্বপ্ন। কখনও বা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র আহ্বান। ভবিষ্যৎ ভারতের যে ছবিটির কথা এত দিন বলে এসেছেন মোদী, এ বার তা ব্যাপক সমর্থন পেল তথ্যপ্রযুক্তির দৈত্যদের কাছে। মাইক্রোসফট, অ্যাপল থেকে গুগ্ল— কে নেই! গত রাতে তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ার অন্তত সাড়ে তিনশোটি সংস্থার সিইও-রা নৈশভোজের টেবিলে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন, ভারত নিয়ে তাঁরা আগ্রহী। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর আগামী ভারতের যে স্বপ্ন মোদী দেখছেন, পরিবর্তনের সেই যজ্ঞে সামিল হতে চান তাঁরাও।
মাত্র ক’দিন আগে খড়্গপুর আইআইটির এক প্রাক্তনী গুগ্লের সিইও হওয়ার পর তাঁকে অভিনন্দনে ভরিয়ে দিয়েছিলেন মোদী। সেই সুন্দর পিচাই আজ মোদীকে সঙ্গে করে ঘুরে দেখিয়েছেন এই মুহূর্তে তাঁদের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রকল্পের অন্দরমহল। ব্যাখ্যা করেছেন, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্নে কী ভাবে কাজে লাগবে তাঁদের প্রকল্প। গুগ্ল আর্থের উন্নততম ভার্সান মোদীকে খুঁজে দিয়েছে বিহারের প্রত্যন্ত খাগাউল— যেখানে ছিল আর্যভট্টের তৈরি মানমন্দির। কিংবা রক্তের শর্করা মাপার ‘প্রজেক্ট আইরিস’। গুগ্ল দফতরে তখন চলছিল সফটওয়্যার তৈরির মেলা— ‘হ্যাকাথন’। মোদী অনুভব করেছেন, ভারতেও তা দরকার। এর অনেক আগেই অবশ্য দফতরে ঢোকার মুখেই বলেছিলেন, ‘‘ভিজিট টু গুগ্ল গুরু!’’
পরিস্থিতি দেখে অনেকেই বলছেন, মোদীর আমেরিকা সফরের প্রথমার্ধ রীতিমতো ঢাকাই পড়ে গেল দ্বিতীয়ার্ধে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভা, জি-৪, পাক কূটনীতি— সব কিছুকে ছাপিয়েই উঠে এল তাঁর সিলিকন ভ্যালি সফর— ডিজিটাল ভারতের জয়জয়কার। কাল রাতে তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় পা রাখার পর থেকেই মোদীকে ঘিরে ছিল প্রবাসী ভারতীয়দের অন্তহীন উচ্ছ্বাস। কর্মসূত্রে সিলিকন ভ্যালিতে রয়েছেন অনেক ভারতীয়। আর এখন তো গুগ্ল-মাইক্রোসফটের শীর্ষ কর্তাদেরও যোগ ভারতে। সুন্দর পিচাইয়ের পাশে মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেল্লাও তো জ্বলজ্বল করছেন। কিংবা অ্যাডোবের সিইও শান্তনু নারায়ণ!
প্রধানমন্ত্রী নৈশভোজের আসরে কী বলেন, জানতে কৌতূহল কম ছিল না। তা মোদী হতাশ করেননি। লঘু চালে তাঁর একাধিক মন্তব্য যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। যেমন— ফেসবুক, টুইটার আর ইনস্টাগ্রাম এখন আমাদের নতুন প্রতিবেশী। টুইটার সবাইকে বানিয়েছে রিপোর্টার। আরও বলেছেন, ‘‘জেগে আছেন, না ঘুমিয়ে এখন সেটা বড় কথা নয়, আসল কথাটা হল আপনি অনলাইন রয়েছেন না অফলাইন!’’
আগামী দিনের ভারতে সরকারি কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, গোটাটাই হবে ‘ডিজিটাল’— এই হল ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্নের গোড়ার কথা। আর আজ তেত্রিশ বছর পরে ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী সিলিকন ভ্যালিতে পা রেখে যখন বদলে যাওয়া পৃথিবীকে এই ভাষায় ব্যাখ্যা করছেন, স্বাভাবিক ভাবেই তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার নক্ষত্ররা। মোদীকে শুধু স্বাগত জানানোই নয়, বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভবিষ্যতের ডিজিটাল ভারতের সঙ্গে থাকবেন তাঁরাও।
গুগ্ল-সিইও সুন্দর পিচাই যেমন বলেছেন, ‘‘জেগে ওঠা দেশগুলির মধ্যে সব থেকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে ভারত।’’ মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেল্লা বলেছেন, তথ্যপ্রযুক্তির সুতোয় ভারতের শ্রীকাকুলামের সঙ্গে কেনিয়ার নানউকিকে জোড়ার কথা। তাঁর মন্তব্য, ‘‘মোদী ঠিক পথে এগোচ্ছেন। যে কাজ তিনি করতে চাইছেন, তা একেবারে ঠিক।’’ পিচাই জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতের পাঁচশোটি রেল স্টেশনে বিনা পয়সায় ওয়াই-ফাই পরিষেবা দেবে গুগ্ল। আর মাইক্রোসফট সিইও নাদেল্লা জানিয়েছেন, ভারতের পাঁচ লক্ষ গ্রামকে সস্তার ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তিতে জুড়তে যে পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার, সেই প্রকল্পের অংশীদার হবেন তাঁরাও। অ্যাডোব সিইও শান্তনু নারায়ণ মোদীর পরিকল্পনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আর সিসকোর সিইও জন চেম্বারস ভারতে মোদীকে তুলে ধরেছেন ডিজিটাল বিপ্লবের ‘আশ্চর্য দূত’ হিসেবে। তাঁর উচ্ছ্বসিত মন্তব্য, ‘‘ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্বেই আপনি পরিবর্তন আনতে পারবেন!”
No comments:
Post a Comment