সংস্থার মুখ উজ্জ্বল করবে, এই আশায় বড় সাধ করে তাকে এনেছিল এয়ার ইন্ডিয়া। স্বপ্নের সেই বিমান ‘ড্রিমলাইনার’ই কথায় কথায় মুখ থুবড়ে পড়ে ক্রমশ মুখ ডুবিয়ে চলেছে। লোকসানে ধুঁকতে থাকা সরকারি সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া যাকে প্রচারের মুখ করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে, বিড়ম্বনা বাড়িয়ে চলেছে সেই মহার্ঘ বিমান।
সোমবার মাঝরাতে এমনই এক ড্রিমলাইনার বিমান ২১৮ জন যাত্রী নিয়ে দিল্লি থেকে হংকং যাওয়ার পথে জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয় কলকাতায়। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, রাতে কলকাতার আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বিমানের ভিতরে অদ্ভুত একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসে। কী থেকে সেই দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, তা বোঝা যায়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, কোথাও আগুন লেগে এমন গন্ধ বেরোতে পারে। কিন্তু ককপিটে বসে পাইলট কোথাও কোনও আগুনের সঙ্কেত পাননি। তবে কোনও ঝুঁকিও নিতে পারেননি তিনি। তাই বিমান নিয়ে নামতে বাধ্য হন কলকাতায়। রাত তখন প্রায় সওয়া ২টো। কলকাতায় ড্রিমলাইনার বিমানের সবে-ধন ইঞ্জিনিয়ারকে জরুরি তলব করে বিমানবন্দরে আনা হয় গন্ধ-বিচারের জন্য। শেষ পর্যন্ত জানা যায়, বাতানুকূল যন্ত্র বিগড়ে গিয়েছে এবং সেটাই এই বিচিত্র গন্ধের উৎস।
গগনবিলাসীদের মন পেতে হাজারো বিমানের ভিড়ে কৌলীন্যে এগিয়ে থাকা ড্রিমলাইনারকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সংস্থার মান বাড়িয়ে ব্যবসায়িক সাফল্যের লক্ষ্য তো ছিলই। তাই টিকিটের দাম অনেকটা বেশি। দক্ষ পাইলট ছাড়াও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকা লাগে এই বিমানে। তা সত্ত্বেও ড্রিমলাইনারের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য টাকা ঢালতে ইতস্তত করেনি এয়ার ইন্ডিয়া। কিন্তু বারে বারেই খাবি খাচ্ছে ওই বিমান। দু’দিন আগেই কলকাতার উদ্দেশে ওড়ার মুখে যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য দিল্লিতে আটকে পড়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার অন্য একটি ড্রিমলাইনার। সারাই না-হওয়ায় সে-দিনের মতো বাতিল করা হয় সেই উড়ান।
সব মিলিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার হাতে এই মুহূর্তে রয়েছে মোট ২১টি ড্রিমলাইনার। কিন্তু হুটহাট বিগড়ে যাওয়ায় তারা লাগাতার বিব্রত করে চলেছে সংস্থাকে। অথচ অস্ট্রেলিয়া, রোম, প্যারিস, লন্ডন-সহ বিভিন্ন রুটে এই আধুনিক বিমান চালিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে চাইছে এয়ার ইন্ডিয়া। কিন্তু বিদেশি রুটেও মুখ রাখছে না ওই বিশেষ বিমান। অগস্টে প্যারিস থেকে ছাড়ার আগেই বিগড়ে গিয়েছিল একটি ড্রিমলাইনার। এখানেই শেষ নয়। পরের দিন ছাড়তে গিয়ে আবার একই সমস্যা দেখা দেয়। দিল্লি আসতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যায় যাত্রীদের।
যে-বিশেষ বিমান যন্ত্রাংশ থেকে সাজসজ্জা, সবেতেই অতি-আধুনিক, তাতে এত ঘনঘন যান্ত্রিক ত্রুটি কেন?
এয়ার ইন্ডিয়ার এক কর্তা জানান, এক দিক থেকে স্বাতন্ত্র্যই ড্রিমলাইনার বিমানের সমস্যা। তাঁর ব্যাখ্যা, অতি-আধুনিক হওয়ার দরুন বিমানটি একটু বেশিই সংবেদনশীল। অন্য বিমান যে-ত্রুটি নিয়ে অনায়াসে উড়ে যেতে পারে, তেমন সমস্যা থাকলে ড্রিমলাইনার নিয়ে ওড়া যায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিদেশে আরও অনেক বিমান সংস্থা এই ড্রিমলাইনার বিমান ব্যবহার করছে। কিন্তু অন্য কোনও দেশ থেকে তো এত ঘনঘন বিমান-বিভ্রাটের খবর আসছে না। এ দেশে যন্ত্র এত বিগড়োচ্ছে কেন?
সরাসরি জবাব দেওয়ার কেউ নেই। তবে এয়ার ইন্ডিয়ার একাংশের অভিযোগ, তুলনায় তাদের হাতে ড্রিমলাইনারের ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা খুবই কম। কলকাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে মাত্র এক জন ইঞ্জিনিয়ার। এর ফলে বিমানে সামান্য ত্রুটি ধরা পড়লে অন্যান্য বিমান সংস্থা যত দ্রুত তা সারিয়ে ফেলে, এখানে তা সম্ভব হয় না। ক্রমে সেই ত্রুটি বড় আকার নেয় এবং শেষ পর্যন্ত বিমান বসিয়ে দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পাইলটদের নিয়ে সমস্যা। তুলনায় কম বেতন পাচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলে সংস্থার ড্রিমলাইনার-পাইলটেরা একের পর এক পদত্যাগপত্র জমা দিচ্ছেন। ফলে অনেক সময় বিমান থাকলেও পাইলটের অভাবে তা চালানো যাচ্ছে না। দিন কয়েক আগে রোম যাওয়ার পথে দিল্লিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছিল যাত্রীদের। রোমে পৌঁছতে উদ্গ্রীব সংযুক্তা দাশগুপ্ত প্রেয়ার নামে এক মহিলা যাত্রী দিল্লি বিমানবন্দরে বসে নিজের অসন্তোষের কথা জানান। জানা যায়, পাইলটের অভাবে সময়মতো ছাড়তে পারেনি সেই স্বপ্নের উড়ান। বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরে অন্য পাইলট এনে বিমানটিকে রওনা করিয়ে দেওয়া হয়। গত শুক্রবারেও দিল্লি থেকে হংকং যাওয়ার ড্রিমলাইনার বাতিল করতে হয় পাইলটের অভাবে।
সোমবার রাতে আবার বিপত্তি সেই দিল্লি-হংকং রুটেই। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, বিগড়ে যাওয়া ড্রিমলাইনার কলকাতায় নামার পরে যাত্রীদের সারা রাত বসিয়ে রাখা হয় টার্মিনালেই। এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন যাত্রীদের একাংশ। মঙ্গলবার সকালে তাঁদের শহরের হোটেলে পাঠানো হয়। তার আগেই কয়েক জন অবশ্য ভোরের উড়ান ধরে দিল্লি ফিরে যান। এয়ার ইন্ডিয়ার তরফে জানানো হয়, অত যাত্রীকে হোটেলে জায়গা দিতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। আটকে পড়া বিমান সারাতে মুম্বই থেকে ইঞ্জিনিয়ার এবং কিছু যন্ত্রাংশ উড়িয়ে আনতে হয়।
মেরামতির পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিমানটি হংকং উড়ে যায়।
No comments:
Post a Comment