Tuesday, November 24, 2015

তুরস্কের গোলায় ধ্বংস রুশ যুদ্ধবিমান

ঠিক এক সপ্তাহ আগের কথা। প্যারিসে জঙ্গি হামলার পর ইসলামিক স্টেটের আগ্রাসন ঠেকাতে সিরিয়ার মাটি থেকে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল রাশিয়া। তখন থেকেই আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলি রাশিয়ার এই নীতির সমালোচনায় মুখর হয়েছে। সেই যুদ্ধ শুরুর সাত দিনের মাথায় আজ একটি রুশ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামাল মার্কিন-ঘনিষ্ঠ দেশ তুরস্ক। তাদের দাবি, বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও আকাশসীমা লঙ্ঘন করে সিরিয়া পেরিয়ে তুরস্কের আকাশপথে ঢুকে পড়েছিল রুশ যুদ্ধবিমানটি। রাশিয়া অবশ্য সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আঙুল তুলেছে ন্যাটোর অন্যতম সদস্য দেশটির দিকেই। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথায়, ‘‘আসলে জঙ্গিদের সাহায্য করতেই আমাদের পিছন থেকে ছুরি মেরেছে তুরস্ক!’’
সন্ত্রাস নিয়ে যখন একজোট হয়ে লড়ার দাবি উঠছে গোটা বিশ্ব জুড়ে, ঠিক তখনই এই ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠে গেল, তা হলে কি এই যুদ্ধকে ঘিরে দু’ভাগ হয়ে গেল পশ্চিমী দুনিয়া? এক দিকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সদস্য দেশগুলি, অন্য দিকে রাশিয়া? সেই ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার মতো?
তুর্কি সেনা সূত্রের দাবি, মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ২০ নাগাদ তুরস্কের হাতারি প্রদেশের সীমান্তবর্তী ইয়ায়লাদাগি এলাকার আকাশপথে ঢুকে পড়েছিল একটি যুদ্ধবিমান। তখনও বিমানটি কোন দেশের তা তারা জানতে পারেনি বলেই দাবি করেছে তুরস্ক। তাদের দাবি, রুশ ‘সুখোই সু-২৪’ বিমানটিকে পাঁচ মিনিটে অন্তত দশ বার সতর্ক করা সত্ত্বেও সেটি নির্দিষ্ট পথে ফিরে যায়নি। সেই সময় নজরদারিতে ছিল দু’টি তুর্কি এফ-১৬ বিমান। তারাই গুলি করে নামায় সুখোই বিমানটিকে।
রাশিয়া অবশ্য তুরস্কের যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, প্রথমত, সু-২৪ সুখোই বিমানটি সিরিয়ার আকাশসীমার মধ্যেই ছিল। দ্বিতীয়ত, তুরস্কের কোনও যুদ্ধবিমান নয়, রুশ বিমানটিকে গুলি করা হয়েছিল মাটি থেকে। পরে অবশ্য এই বক্তব্য থেকে পিছু হটে তারা। পুতিন নিজেই জানান, তুরস্কের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র (বায়ু থেকে বায়ু ক্ষেপণাস্ত্র) ছোড়া হয়েছিল। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ওড়ার পর থেকে গোটা সময়টাই সিরিয়ার আকাশে ছিল যুদ্ধবিমানটি। হানার সময় ৬০০০ মিটার উচ্চতায় ছিল বিমানটি। রাশিয়া এ-ও জানিয়েছে, তাদের যুক্তির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ‘কন্ট্রোল সিস্টেম’-এর তথ্য প্রকাশ করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে সব। পরে জর্ডনের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহর সঙ্গে বৈঠকে তুরস্কের প্রসঙ্গ তুলে পুতিন বলেন, ‘‘আমাদের বিমানটি ভেঙে পড়েছে তুরস্ক সীমান্ত থেকে চার কিলোমিটার দূরে সিরিয়ার ভিতরে...। সুতরাং আমাদের পাইলটরা কোনও ভাবেই নিয়ম ভাঙেননি।’’ ঘটনার প্রতিবাদে ইস্তানবুল সফর বাতিল করেছেন রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।
পুতিন যা-ই দাবি করুন, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোলু কিন্তু অনড়। কিছুটা কড়া সুরেই নাম না করে রাশিয়ার উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘‘এটা সকলেরই জানা উচিত যে, দেশের আকাশ কিংবা জমির সীমা লঙ্ঘন করলে যে কোনও পদক্ষেপ করার অধিকার আমাদের রয়েছে।’’
এই বিতর্কের মধ্যেই ইন্টারনেটে ছড়িয়েছে একটি ভিডিও ফুটেজ। যাতে দেখা গিয়েছে, আগুনের গোলার মতো এসইউ-২৪ ভেঙে পড়ছে সিরিয়ার তুর্কোমেন পার্বত্য এলাকায়। পরে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানায়, যুদ্ধবিমানটির দুই পাইলটই শেষ মুহূর্তে প্যারাশ্যুটে করে বিমান থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। প্রাথমিক ভাবে এক পাইলটের মৃত্যুর খবর মেলে। আর এক পাইলট সিরীয়-তুর্কমেন বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি বলে জানা যায়। যদিও বেশি রাতে তুরস্ক সরকারের তরফে দাবি করা হয়, দুই পাইলটই জীবিত রয়েছেন। তাঁদের উদ্ধার করতে সেনা নামিয়েছে তুরস্ক।
সিরিয়া সীমান্তের যে এলাকায় বিমানটি ভেঙে পড়েছে, সেই তুর্কমেন প্রদেশে সক্রিয় রয়েছে একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী। এক দিকে, সিরিয়া-আল কায়দা, অন্য দিকে নুসরা ফ্রন্ট নামে এক জঙ্গি সংগঠন। আবার রয়েছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বিরোধী সিরীয়-তুর্কমেন বিদ্রোহীরাও (এরা কিন্তু আইএস-সমর্থক নয়)। তুরস্ক বরাবরই দাবি করে আসছে, তুর্কমেন প্রদেশে হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের মারার বদলে রুশ সেনা সাধারণ মানুষকেই নির্বিচারে হত্যা করছে। এ নিয়ে গত শুক্রবার রুশ রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে সিরিয়া সীমান্তে সেনা-অভিযান বন্ধ করার দাবিও জানিয়েছিল আঙ্কারা। এমনকী রাষ্ট্রদূত অ্যান্ড্রে কারলভকে কার্যত হুমকি দিয়ে সে দিন আঙ্কারার তরফে বলা হয়েছিল, অভিযান থামানো না হলে পরিণতি খারাপ হবে। বস্তুত, আজই রুশ যুদ্ধবিমানটিকে গুলি করে নামানোর ঘণ্টাখানেক আগে, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তুর্কমেন প্রদেশে রুশ সেনা-অভিযানের প্রসঙ্গ তুলেছিল তুরস্ক। এর পিছনে কারণও রয়েছে। তুর্কমেনের বাসিন্দারা খাতায়কলমে সিরীয় নাগরিক হলেও তাঁদের শিকড় রয়েছে তুরস্কে। সেখানে আসাদ-বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে রুশ সেনার হামলাকে কখনওই সমর্থন করেনি তুরস্ক। তারা বরাবরই চেয়েছিল আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হোন।
রুশ যুদ্ধবিমানটির আকাশসীমা লঙ্ঘন নিয়ে সরব হওয়া ছাড়া এ দিন বিষয়টি নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করেনি আঙ্কারা। মস্কো অবশ্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ‘তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্কের উপর এই ঘটনার প্রভাব পড়বেই। পরিণতি ভুগতেই হবে তুরস্ককে’। উল্লেখযোগ্য, ১৯৫০ সালের পর এই প্রথম ন্যাটোর কোনও সদস্য দেশ রুশ যুদ্ধবিমানের উপর হামলা চালাল। তাই ‘পরিণতি’ ঠিক কী হতে চলেছে, তা নিয়ে আশঙ্কার ছায়া ঘনাচ্ছে পশ্চিমী দুনিয়ায়।

No comments:

Post a Comment