পদবিতে নেই গেটস, জোবস কিংবা জুকারবার্গ।আছে বন্দ্যোপাধ্যায়, নাগ কিংবা গুপ্ত।তবু টিনএজ পেরোনোর আগেই কোটি টাকার স্টার্টআপ।অ্যাপসের দুনিয়ায় তরুণ উদ্যোগপতিদের অভাব নেই। বিল গেটস, স্টিভ জোবস, সের্গেই ব্রিন, ল্যারি পেজ পেরিয়ে মার্ক জুকারবার্গ, ইভান স্পিগল — অল্পবয়সি অনেক উদ্যোগপতি দেখেছে দুনিয়া।
এঁদের শুরু কিন্তু কুড়ি পেরিয়ে।সময় বদলেছে।আজ শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়, দিব্যা নাগ, রোহন অগ্রবাল বা শ্রেয়া শঙ্কর-রা শুরু করে দিয়েছে টিনএজ পেরোনোর আগেই। অনেকে তো আবার দশে পড়ার আগেই! তাদের কারও কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে ইনটেল, কারও ক্ষেত্রে অ্যাপল, তো কারও সাহায্যে এগিয়ে এসেছে গুগল।আর এরা স্টার্টআপ দুনিয়ায় প্রবেশের বয়সটাই শুধু নামিয়ে আনেনি। প্রবেশ করিয়েছে এক ঝাঁক ভারতীয় পদবিরও।

শুরুর শুরু
যে বয়সের আর পাঁচজন হোমওয়ার্ক, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম নিয়ে হিমশিম সেখানে তেরো বছরের ছেলে মেতে লেগো মাইন্ডস্টর্ম ইভিথ্রি কিটে। কেন? লেগো ব্লক দিয়ে দৃষ্টিহীনদের পড়ার সুবিধার জন্য কম খরচের ব্রেইল প্রিন্টার বানাবে। এমন অবস্থায় বাবা-মায়ের আঁতকে ওঠাই স্বাভাবিক। ক্লাস এইটের শুভম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে বার্নপুরে বেড়ে ওঠা বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা ক্লারার বাসিন্দা নীলয় আর মালিনী বন্দ্যোপাধ্যায় ছেলেকে বাধা দেননি। বরং সাহায্যই করেছেন।
‘‘আমি তো স্টার্টআপ করব বলে কিছু করিনি। হু-এর একটা রিপোর্টে পড়েছিলাম পৃথিবীতে দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা সাড়ে আঠাশ কোটি।
যার নব্বই শতাংশই বাস করে উন্নয়নশীল দেশে। চেয়েছিলাম যদি অল্প খরচে তাঁদের জন্য একটা প্রিন্টার বানানো যায়,’’ স্কাইপে বলছিল শুভম। ২০১৩-র ডিসেম্বরের শেষ তিন সপ্তাহ খাওয়াদাওয়া ভুলে লেগে ছিল প্রিন্টারটা
বানাতে। স্কুল থেকে ফিরে হোমওয়ার্ক-অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করেই বসে পড়ত ব্রেইগো নিয়ে। কোনও কোনও দিন রাত দু’টোও হয়ে গিয়েছে কাজ করতে করতে। পর দিন আবার স্কুল।
পরের বছর ইনটেল ডেভেলপার্স ফোরামে তার তৈরি প্রিন্টার ‘ব্রেইগো’র ডেমো দেখিয়েছিল শুভম। চমকে গিয়েছিল ইনটেল। কারণও স্পষ্ট। ব্রেইল প্রিন্টার তৈরি করতে শুভমের খরচ পড়েছিল সাড়ে তিনশ ডলার (ভারতীয় টাকায় মোটামুটি একুশ হাজারের কাছাকাছি)। আর সে সময় একটা ব্রেইল প্রিন্টারের বাজার দর কত? দু’হাজার ডলার (ভারতীয় টাকায় এক লাখ কুড়ি হাজারের মতো)। বিনিয়োগের এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি ইনটেল। টাকা ঢেলেছিল শুভমের ব্রেইগো ল্যাবস-এ।
ব্রেইল প্রিন্টার ‘ব্রেইগো’তে ব্যস্ত শুভম
রোবটিক্সের কাজে মেতে রোহন
জাস্ট হয়ে গেছে
শুভমের মতোই অল্প বয়সে স্টার্টআপ হাতেখড়ি রোহনের। শুভম যখন ব্যস্ত ব্রেইগো নিয়ে, প্রায় একই সময় ষোলো কিলোমিটার দূরে কাপারটিনোয় রোহন অগ্রবালও পা রেখেছে স্টার্টআপ দুনিয়ায়। গরমের ছুটিটা ভিডিয়ো গেম খেলে কাটিয়ে দেওয়ার বদলে বারো বছরের ছেলে যোগ দিয়েছিল ইনটার্নশিপে। ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলের ওলজিক-এ, যারা গবেষণা করে রোবট প্রযুক্তি নিয়ে। ইনটার্নশিপের দ্বিতীয় দিনেই রোহন বানিয়েছিল এক রোবট। ফার্মের প্রধান অবাক হলেও, রোহনের পক্ষে কিন্তু সেটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। চার বছর বয়সে নিজে নিজে শিখে নিয়েছিল কম্পিউটারে প্রোগ্রাম বানানোর কোডিং। পাঁচ বছর বয়সে এইচটিএমএল-এ বানিয়ে ফেলেছিল ওয়েবসাইট। আর তেরোর জন্মদিনে পড়তে না পড়তে নিজেই খুলে ফেলেছিল এক রোবোটিক্স কনসাল্টেন্সি ফার্ম। অন্যদের রোবট প্রযুক্তিতে সাহায্য করার জন্য! স্বাভাবিক ভাবেই রোহনকে নিয়ে চর্চা এখন সব টেক ম্যাগাজিনে।
রোহনের মতো অনসুল সমরের শুরুও একই বয়সে। একটা গেমিং কোম্পানি। তবে ভিডিয়ো গেম না। কার্ড গেম। রোল প্লেয়িং কার্ড গেমের মাধ্যমে কেমিস্ট্রি শেখানো। খেলার ছলে পড়াশোনা। বিক্রি কম হয়নি। প্রথম বছরের রেভেনিউ দশ লাখ ডলার। যে বয়সে আর পাঁচজন ভেসে বেড়াচ্ছে সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোয়, সেখানে এরা কেন মেতে উঠেছে নিজের কোম্পানি তৈরিতে? রোহনের জবাব স্পষ্ট। ‘‘যত অল্প বয়সে শুরু করা যায়, ততই ভাল। যত সময় যাবে তত অন্যদের থেকে দূরত্ব বাড়বে। আর অল্প বয়সে শুরু করার বাড়তি সুবিধা হল, তখন বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সার চিন্তা মাথায় থাকে না। ফলে শুধু নতুন সৃষ্টির আনন্দেই মেতে থাকা যায়।’’
শুভমের উত্তরও প্রায় একই। তার আইডল স্টিভ জোবস আর বিল গেটস। তা বলে আইডলদের বিলিয়ন ডলার কোম্পানি দেখে স্টার্টআপে এগিয়ে আসেনি সে। ‘‘মিলিয়নেয়র-বিলিয়নেয়র হওয়ার জন্য কেউ স্টার্টআপ করে না। ওটা সব সময় হয়ও না। আমার ক্ষেত্রেও না। গুগলে দেখেছিলাম ব্রেইল প্রিন্টারের অনেক দাম। তাই চেয়েছিলাম কম খরচের একটা প্রিন্টার করতে। ইনটেল-টা জাস্ট হয়ে গেছে,’’ বলছিলেন শুভম।

কলেজছুটের পর
তবে ‘জাস্ট’ হয়ে যাওয়া মানতে নারাজ দিব্যা নাগ।
না হলে আর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করার আগেই বেরিয়ে আসবে কেন! তার আইডল স্টিভ জোবসও যে কলেজ ড্রপ আউট। উনিশ বছর বয়সে কলেজছুট দিব্যা শুরু করেছিল স্টেম সেল থেরানসটিক্স। স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা করার এক স্টার্টআপ। সেখান থেকেই তৈরি হয় স্টার্টএক্স মেড। এখন সে কোম্পানি প্রায় তিরিশটার মতো হেল্থকেয়ার টেকনোলজি সংস্থাকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়। মজার ব্যাপার। গত বছর থেকে দিব্যার কোম্পানির সঙ্গে কাজ শুরু করেছে তারই আইডলের তৈরি করা কোম্পানি। অ্যাপল। ফোর্বস পত্রিকা প্রতি বছর তিরিশের কমবয়সি তিরিশজন প্রভাবশালীর যে ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ লিস্ট তৈরি করে, স্বাভাবিক ভাবে তাতেও উঠে এসেছে দিব্যার নাম। কিন্তু উনিশ বছর বয়সে কলেজ ছাড়তে ভয় করেনি? ‘‘না,  আমার ভয় করেনি। জানতাম, আমি কী করতে চাই। ভবিষ্যতের পুরো ছবিটা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল,’’ উত্তর দিব্যার।
যদিও স্টিভ জোবস বা বিল গেটসদের সঙ্গে জেন ওয়াইয়ের এই স্টার্টআপগুলোর একটা পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। সত্তর দশকের মাঝামাঝি জোবস যখন ওজনিয়াককে নিয়ে তৈরি করছেন অ্যাপল ওয়ান বা পল অ্যালেনকে সঙ্গে নিয়ে গেটস শুরু করছেন মাইক্রোসফট, কম্পিউটার ব্যবস্থাই তখন ছিল শৈশবে। স্বাভাবিক ভাবেই তাই সে সময়ের স্টার্টআপগুলোর অভিমুখও ছিল কম্পিউটার। একুশ শতকের গোড়ায় মার্ক জুকারবার্গের স্টার্টআপ ফেসবুকও সেই কম্পিউটার ব্যবস্থার উপরই তৈরি। কিন্তু পরের দশক থেকে যেই জোয়ার এলো মোবাইল কম্পিউটিংয়ে, স্টার্টআপের চরিত্রও বদলে যেতে থাকল ধীরে ধীরে। এলো অ্যাপ নির্ভর স্টার্টআপের বিপ্লব। ২০০৯-এ ব্রায়ান অ্যাকটন আর ইয়ান কুমের হোয়াটসঅ্যাপ হোক কিংবা ২০১১য় ইভান স্পিগলের স্ন্যাপচ্যাট — সবই কিন্তু তার ফলশ্রুতি।
মা মালিনী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শুভম
বন্ধু, খেলাধুলো, হোমওয়ার্ক
নেহা গুপ্তের প্রায় দশ লাখ ডলার সংগ্রহ করা ‘এমপাওয়ার অরফানস’ কিংবা শ্রেয়া শঙ্করের ভার্চুয়াল কম্পিউটার ক্লাস ‘ক্যাম্প সাই গার্ল’ও তেমনই। শুভমের স্টার্টআপের লক্ষ্য যদি হয় দৃষ্টিহীনদের সাহায্য, তবে নেহার স্টার্টআপ শুরু হয়েছিল অনাথ শিশুদের সাহায্যের জন্য। আর শ্রেয়ার লক্ষ্য ছিল সায়েন্স আর টেকনোলজিতে লিঙ্গবৈষম্য দূর করা। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ক্যাম্পে হাতে গোনা কয়েকজন মেয়ে। সেটা ভাল লাগেনি শ্রেয়ার। ইমেলে বলছিল, ‘‘মেরিসা মেয়ার (ইয়াহু-র প্রেসিডেন্ট এবং সিইও) কিন্তু ঠিকই বলেছে। টেকনোলজিকে এখনও ছেলেদের ক্ষেত্র বলেই ভাবা হয়। মেয়েদেরকে সব সময় একটা আলাদা ব্র্যাকেটে রাখা হয়।’’ তাই শ্রেয়া তৈরি করেছিল ‘ক্যাম্প সাই গার্ল’। মেয়েদের জন্য এক ভার্চুয়াল সায়েন্স ক্যাম্প। যেখানে কেউ অনায়াসে শিখে নিতে পারে সোজাসাপ্টা কোডিং থেকে ওয়েবসাইট তৈরির খুঁটিনাটি। গত বছর ক্যাটাপুল্ট-এ তার স্টার্টআপ সম্বন্ধে বলার পর থেকে অনেক ভে়ঞ্চার ক্যাপিটালিস্টই আগ্রহ দেখিয়েছে তার সংস্থায়। এখনও পর্যন্ত স্পনসর আর গ্রান্টে চলা ‘ক্যাম্প সাই গার্ল’ গত মাসে অ্যাডভাইসর হিসেবে পেয়েছে গুগল-এর এমিলি স্যালিবা-কে।
বন্ধুদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এত কিছুর মধ্যে নিজের জন্য সময় বের করতে অসুবিধা হয় না? ‘‘সত্যি খুব অসুবিধা হয়,’’ জানাল রোহন। একই উত্তর শ্রেয়ারও। শুভম তো আবার স্কুলে ফুটবলও খেলে। সময় বের করতে পারে খেলাধুলোর জন্য? ‘‘ওটা করে নিতে হয়। তবে বন্ধুদের জন্য সময় বের করা মুশকিল হয়ে যায়। সপ্তাহের একটা রুটিন করে নিই। পড়াশোনা, কোম্পানির কাজ, মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো — সব কিছুর জন্য একটা সময় ঠিক করে নিই। তা ছাড়া আর কী করব?’’
স্টার্টআপ নিয়ে না হয় মেতে থাকল ছেলে-মেয়ে। কিন্তু তাদের বাবা-মায়েরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন? তাঁদের কি মনে হয় না, স্টার্টআপের পিছনে এত সময় দেওয়া পণ্ডশ্রম হবে? ইমেলে প্রশ্নটা করেছিলাম শুভমের মা মালিনী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। জানালেন, প্রথম দিকে ছেলের কথায় একদম রাজি ছিলেন না। বিশেষ করে স্কুলের সায়েন্স প্রোজেক্টের জন্য হাজার তেইশ টাকার লেগো কিনে দেওয়াতেও সায় ছিল না। কিন্তু প্রথম বার ব্রেইগোতে ব্রেইল প্রিন্ট দেখে উপলব্ধি করেছিলেন, ‘‘নিজেদের ইনসিকিওরিটি ছেলে-মেয়ের উপর চাপিয়ে দিতে নেই। চাপাচাপিতে হয়তো ওরা বাবা-মায়ের কথা মেনে নিল, কিন্তু তাতে খুশি হতে পারবে কি! আমার মতে, ছেলে-মেয়েদের উপর ভরসা রাখা উচিত। কারও সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়। বরং সব সময় ওদের পাশে থাকা জরুরি।’’ তাই আট বছরের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে ছেলের পাশে থাকতে তিনিও যোগ দিয়েছেন ব্রেইগোতে।
আর শুভম, শ্রেয়া, নেহা, অনসুল, রোহন-রা? যারা উদ্বুদ্ধ হবে তাদের দেখে, তাদের জন্য কোনও টিপস?
রোহনের উত্তর দু’টো শব্দে। ‘‘জাস্ট স্টার্ট।’’
সত্যিই তো কথায় আছে না, ‘এজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার!’