টেনিস প্লেয়ারদের কাছে লকাররুম হল ‘ঠাকুরঘর’। যাবতীয় একান্ত ব্যক্তিগত টেনিস-ইস্যু, প্রার্থনা, কষ্ট-আনন্দ-যন্ত্রণা উপলব্ধির স্থল ওটা। মি়ডিয়া তো সুদূর মঙ্গলগ্রহের বস্তু, প্লেয়ারের খুব ঘনিষ্ঠ কেউ এমনকী পরিবারেরও সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। সর্বক্ষণ রুদ্ধদ্বার।
ডিএলটিএ-তে ভারতীয় ডেভিস কাপ দলের লকাররুমের সেই অমোঘ দরজা শুক্রবার বিকেলের দিকে চিচিং ফাঁক!
এবং সেটা যে ‘মন্ত্রে’ তার নাম সোমদেব দেববর্মন।
ওয়ার্ল্ড গ্রুপে ওঠার চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রথম দিনে ডেভিসের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর দেশ চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ভারতকে অপ্রত্যাশিত ১-১ স্কোরলাইনে সোমদেব রাখার পরেই গিয়ে ঝাঁপ দেন লকাররুমের ঠিক পিছনে থাকা সুইমিং পুলে। আনন্দের উত্তেজনায় লকাররুমে ঢুকে দরজাটা পর্যন্ত ভেজাতে ভুলে যান তিনি! সামান্য ফাঁক সেই দরজা দিয়ে সোমদেবের পুলসেশন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। ১-১-এর আনন্দে ভাসতে থাকা গোটা ভারতীয় দলেরও ‘ঠাকুরঘরের’ নীরবতা রক্ষা নিয়ে যেন হেলদোল নেই!
আসলে ইদানীং পেশাদার সার্কিটে ফর্মে থাকা য়ুকি ভামব্রি আজ দেশের নীল জার্সিতে যতটা বিশ্রী খেলে প্রথম সিঙ্গলসে হেরেছিলেন, পরের ম্যাচে ততটাই দুর্ধর্ষ টেনিসের নিদর্শন রেখে স্কোরলাইনে সমতা ফেরান সম্প্রতি সার্কিটে অফ ফর্মে থাকা সোমদেব।
লুকাস রসোলের কাছে ১১৬ মিনিটে স্ট্রেট সেটে ২-৬, ১-৬, ৫-৭ য়ুকি হারার পর সোমদেব পাল্টা স্ট্রেট সেটে হারিয়ে দিলেন এই টাইয়ে চেক দলের এক নম্বর সিঙ্গলস তারকা জিরি ভেসেলিকে। ৭-৬ (৭-৩), ৬-৪, ৬-৩। অথচ য়ুকির এখন কেরিয়ারের সেরা র‌্যাঙ্কিং চলছে। ১২৫। রসোলের তুলনায় গোটা চল্লিশ ধাপ পিছনে মাত্র। সেখানে এ বছর চারশোর ঘরে র‌্যাঙ্কিং থাকা প্লেয়ারের কাছেও চ্যালেঞ্জারে হেরেছেন সোমদেব। কিন্তু দেশের হয়ে লড়তে নেমে হারালেন বিশ্বের ৪০ নম্বর ভেসেলিকে।
এর পরে সোমদেবকে ‘ইয়ারায় জিম কুরিয়ার’ দেখালে আশ্চর্যের কী আছে!
প্রথম দিনে ০-২ পিছিয়ে থাকা দেশকে পরের দিন ১-২ অন্তত করতেই হবে— এই মরিয়া আগাম ভাবনায় লিয়েন্ডার পেজ এ দিন সকালের বিমানে মুম্বই গিয়ে সন্ধের ফ্লাইটে মেয়ে আইয়ানাকে নিয়ে দিল্লি ফেরার পরিকল্পনা করেও শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছিলেন। উল্টে বরং সাইডলাইনে ভারতীয় দলের বেঞ্চে ‘চিয়ারলিডারের’ ভূমিকা পালন করার ফাঁকে গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়া দুপুর একটার রোদ আর গরমে পাশের কোর্টে প্র্যাকটিসে নেমে পড়েন। কাল ওই সময়েই ডাবলসটা খেলতে হবে বলে। তিনি, লিয়েন্ডারও প্রস্ততি অসমাপ্ত রেখে সেন্টার কোর্টে হুড়মুড়িয়ে ফিরে এলেন। লোকমুখে সোমদেবের প্রথম সেট টাইব্রেকারে জেতার খবর পেয়ে।
লিয়েন্ডারের বাবা ভেস পেজের মতোই ডেভিস কাপ দেখতে সস্ত্রীক দিল্লি এসেছেন জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। দশটা-পাঁচটা টেনিসে কাটিয়ে বেরোবার আগে বলে গেলেন, ‘‘অবাক হওয়ার মতো স্কোরলাইন তো বটেই। এখন তো মনে হচ্ছে, আমরা টাইটা-ও জিতে যেতে পারি। সোমদেবকে এত ভাল খেলতে অনেক বছর দেখিনি। ওর কাউন্টার পাঞ্চার টাইপ টেনিসই আজও খেলেছে। কিন্তু একটাও ভুল রিটার্ন মেরেছে বলে মনে করতে পারছি না। ভেসেলি তাতেই নড়ে গিয়েছে। ভাবতে পারেনি বোধহয়, যা মারব তা-ই ফিরে আসবে!’’
ত্রিপুরার বাঙালির ডেভিসে আজকের জয়ের সঙ্গে তুলনায় আসবে ২০১১-এ ভারতের শেষ ওয়ার্ল্ড গ্রুপের ম্যাচে সার্বিয়ার টিপসারেভিচকে হারানো। কিংবা গত বছর আর এক সার্বিয়া টাইয়ে লাজোভিচের বিরুদ্ধে জয়। অনেকে তুলনা টানলেন, সাত বছর আগে চেন্নাই ওপেনে কার্লোভিচ আর কার্লোস ময়াকে তাঁর হারানোর সঙ্গে। সোমদেব নিজেও স্বীকার করলেন, ‘‘অনেক দিন পরে বিশ্বের প্রথম পঞ্চাশে থাকা কাউকে হারালাম।’’
গোটা কুড়ি ‘এস’, মাত্র একটা ‘ব্রেক’ যেমন গোটা ম্যাচে সোমদেবের তুখোড় সার্ভিসের প্রমাণ, তেমনই শুরুর দিকে খুব ভাল সার্ভিস করতে থাকা ভেসেলির সার্ভ গোটা ম্যাচে তিন বার ভাঙটা আজকের ভারতীয় মহানায়কের দুরন্ত গ্রাউন্ডস্ট্রোকের নিদর্শন। এ দিনের সোমদেবের কয়েকটা ব্যাকহ্যান্ড ডাউন দ্য লাইন, ক্রস কোর্ট, ড্রপ শট বিশ্বের প্রথম দশের কেউ মারতে পারলেও বোধহয় গর্ববোধ করতেন।
আর কে খন্না স্টেডিয়ামে গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্ট বসালেও হয়তো সোমদেব দেববর্মন জিতবেন! শেষ ছ’বছর তিনি এই স্লো হার্ড কোর্টে অপরাজিত। মাঝে এখানে পেয়েছেন কমনওয়েলথ গেমস সোনা আর জোড়া চ্যালেঞ্জার খেতাব। অথচ সোমদেব চেক প্রজাতন্ত্রের হাইকমিশন থেকে মাঠে আসা জনা পঞ্চাশেক চেক সমর্থকের ‘সেসকি-সেসকি’ (কাম অন চেক রিপাবলিক) চিৎকার বিকেলের দিকে থামিয়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত মনে হচ্ছিল য়ুকিরা যেন দিল্লিতে নয়, প্রাগে খেলছেন!
সৌজন্যে য়ুকি ভামব্রি-ই। প্রথম ম্যাচে ভাল সার্ভিসে শুরু করেও যত সময় গড়াচ্ছিল, রসোলের সামনে ততই ঘেঁটে যাওয়া অবস্থায় দেখায় স্থানীয় তরুণ তারকাকে। অসংখ্য আনফোর্সড এরর করলেন। একগাদা ডাবল ফল্ট। দ্বিতীয় সেটের পরে নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেন আনন্দ অমৃতরাজ চেয়ার আম্পায়ারের কাছে ‘টাইম আউট’ চেয়ে য়ুকিকে লকাররুমে নিয়ে গিয়ে টিপস দিয়েও ছবিটা পাল্টাতে পারেননি। উল্টে বিজয় অমৃতরাজের ভাইয়ের অবস্থা তখন যেন হৈমন্তী শুক্লর সেই গানের মতো— ‘আমার বলার কিছু ছিল না...!’
দেদার ফ্রি পাস-এ ঢাক-ঢোল, কাড়া-নাকাড়া সমেত মাঠে ঢোকা দর্শকদের সব বাদ্যধ্বনি য়ুকির পারফরম্যান্সে সকালের দিকে পাষাণ হয়ে গিয়েছিল।
সোমদেবের ‘স্পর্শে’ যা আবার প্রাণ ফিরে পেয়ে বিকেলে স্টেডিয়াম ছাড়ল জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’ স্লোগান দিতে দিতে!